যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় ফিরে পার করেছেন প্রথম ১০০ দিন। এই সময়ে বিশ্বব্যাপী শুল্ক যুদ্ধ শুরু করেছেন, বৈদেশিক সহায়তা কমিয়েছেন, ইউক্রেইনে রাশিয়ার আগ্রাসন নিয়ে নেটো মিত্রদের উপেক্ষা করে রাশিয়ার বয়ানকেই সমর্থন করেছেন। গ্রিনল্যান্ড, পানামা খাল দখল এবং কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম রাজ্যে পরিণত করার কথাও প্রকাশ্যে বলেছেন ট্রাম্প।


এই মেয়াদে ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ কর্মসূচি মিত্রদের দূরে ঠেলে দিয়েছে এবং প্রতিপক্ষদের সাহস জুগিয়েছে। তার পদক্ষেপ এবং সেই সাথে তার অজানা পরবর্তী পরিকল্পনা বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। সমালোচকরা বলছেন, ঘরোয়া রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক চর্চার অবনতি এবং আদালত ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর ট্রাম্প প্রশাসনের চাপ প্রয়োগের ঘটনাগুলো আন্তর্জাতিক উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।


বিশ্বব্যবস্থায় নাড়া 

বার্তাসংস্থা রয়টার্সের এক অনুসন্ধানে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বর্তমান ও সাবেক সরকারি কর্মকর্তা, কূটনীতিক ও বিশ্লেষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ট্রাম্পের পদক্ষেপের কিছু ক্ষতি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। তবে তিনি যদি নমনীয় অবস্থান নেন, তবে তা পুরোপুরি অপরিবর্তনীয় না-ও হতে পারে। অর্থাৎ, সেসব ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।


যদিও কিছু বিষয়ে ট্রাম্প তার কঠোর অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসেছেন, যেমন শুল্ক আরোপের সময়সূচি ও মাত্রা; তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, বড় কোনো পরিবর্তনের আশা কম। ফলে অনেক দেশ ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নিজেদের স্বার্থরক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে।


ইউরোপীয় দেশগুলো নিজেদের প্রতিরক্ষা শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ানোর কথা ভাবছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় নিজস্ব পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। আবার অনেকে মনে করছেন, চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়েছে।


হোয়াইট হাউস অবশ্য ট্রাম্পের সমালোচনা প্রত্যাখ্যান করেছে। জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের মুখপাত্র ব্রায়ান হিউজ এক বিবৃতিতে বলেন, ট্রাম্প ইউক্রেন ও রাশিয়াকে আলোচনার টেবিলে এনেছেন, (মাদক তৈরির উপাদান) ফেন্টানিল প্রবাহ বন্ধ করছেন এবং চীনের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নিয়ে মার্কিন শ্রমিকদের রক্ষা করছেন।


বিশ্ব অর্থনীতিতে ঝড়

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত ৮ দশকে গড়ে ওঠা মুক্তবাণিজ্য, আইনের শাসন এবং ভৌগোলিক অখণ্ডতার ভিত্তির ওপর দাঁড়ানো বিশ্বব্যবস্থা এখন ঝুঁকিতে পড়েছে।


বিশ্বের অধিকাংশ দেশের বিরুদ্ধে মুক্তবাণিজ্যের মাধ্যমে 'যুক্তরাষ্ট্রকে ঠকানোর' অভিযোগ তুলে  ট্রাম্প তার বৈশ্বিক শুল্কনীতির ঘোষণা দেন। এতে বিশ্ববাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, ডলারের দাম পড়ে গেছে এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার আশঙ্কা বেড়েছে।


এদিকে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়েও যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের নীতি প্রায় পুরোপুরি বদলে ফেলেছেন ট্রাম্প। তিনি রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন, এমনকি ন্যাটো-সমর্থিত ইউক্রেনকে তার ভূখণ্ডের দাবি ছাড়তে বাধ্য করতে পারেন বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।


ইউরোপে উদ্বেগ

জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মেৎর্স বলেছেন, এটা ইউরোপের জন্য রাত বারোটার পাঁচ মিনিট আগের সময়, অর্থাৎ পরিস্থিতি অত্যন্ত সংকটময়। তিনি সতর্ক করেছেন, ট্রাম্প যদি 'আমেরিকা ফার্স্ট' নীতিকে 'আমেরিকা একা' নীতিতে পরিণত করেন, তবে ইউরোপের জন্য সম্পর্ক বজায় রাখা কঠিন হয়ে যাবে।


ট্রাম্পের সম্প্রসারণবাদী বক্তব্যও বিশ্বব্যবস্থায় অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। গ্রিনল্যান্ড, কানাডা এবং পানামা খাল অধিগ্রহণের কথা বলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের আধুনিক কূটনৈতিক নীতির ব্যতিক্রম ঘটিয়েছেন।


ট্রাম্পের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ

ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইতিমধ্যেই পাল্টা শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা করছে। জার্মানি ও ফ্রান্স প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে, যা তাদের নিজস্ব প্রতিরক্ষা শিল্পে বিনিয়োগ বাড়াবে এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে কম অস্ত্র কেনার পথ খুলে দেবে।


কানাডা ইউরোপের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সম্পর্ক জোরদার করার চেষ্টা করছে। দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানও তাদের নিরাপত্তা নীতিতে পরিবর্তন আনছে।


বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিছু দেশ চীনের সাথে আরও গভীর অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে। স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ ইতোমধ্যেই বেইজিং সফর করেছেন।


ভবিষ্যৎ কী?

বিশ্লেষক অ্যারন ডেভিড মিলার বলছেন, এখনো সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি। ট্রাম্প চাইলে এখনো পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনতে পারেন।


কিন্তু যদি ট্রাম্প তার কঠোর অবস্থানে অনড় থাকেন, তবে ভবিষ্যতের কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের জন্য বিশ্বব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা কঠিন হবে।


মিলার বলেন, বন্ধুদের সাথে আমাদের সম্পর্কের যে ক্ষতি হচ্ছে এবং প্রতিপক্ষরা যেভাবে সুবিধা নিচ্ছে, তার পরিমাণ হয়তো এখনই পুরোপুরি মাপা যাচ্ছে না।