ইসলামের আগে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নারীদের সম্পর্কে অযৌক্তিক ও অন্যায্য চিন্তা ও ধারণা ছিল। নারীদের সঙ্গে অভদ্র ও নৃশংস আচরণও করা হতো। ইসলাম আবির্ভূত হওয়ার পর নানাভাবে নারীদের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। ইসলাম শুধু নারীদের পূর্ণ অধিকারই দেয়নি, সমাজের অবহেলিত ও বৈষম্যের শিকার এই শ্রেণিকে বৈধভাবে বহু কাজ করতে উৎসাহিত করেছে।
মুসলিম পুরুষরা যেমন প্রতিটি ধর্মীয় ও শিক্ষাগত ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদান রেখেছে, তেমনি নারীরাও অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছে। নবুয়তের যুগ থেকে খুলাফায়ে রাশেদিন, বনি উমাইয়া ও বনি আব্বাসের যুগ পর্যন্ত তারা গৌরবোজ্জ্বল অবদান রেখেছে।
তাদের সেই সব কৃতিত্বের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ও অবদানের কথা ইতিহাসবেত্তারা তবাকাত ও রিজাল শাস্ত্রে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ করেছেন। সেই নারীদের অবদান স্মরণীয় করে রাখতে স্বতন্ত্র গ্রন্থও রচিত হয়েছে।
যেমন—ইমাম তাবরানি (রহ.)-এর ‘আশারাতুন নিসা’, ইবনে তাইফুর (রহ.)-এর ‘বালাগাতুন নিসা’, ইমাম ইবনুল কাইয়্যুম (রহ.)-এর ‘আখবারুন নিসা’, ইমাম সুয়ুতি (রহ.)-এর ‘নুজহাতুল জুলাসা ফি আশআরিন নিসা’ কিংবা গ্রন্থের শেষে ‘কিতাবুন নিসা’ শিরোনামে স্বতন্ত্র অধ্যায়ে নারীদের কথা বলা হয়েছে। আর মুসলিম নারীদের কৃতিত্ব ও অবদানের ওপর গ্রন্থ রচনার ধারাবাহিকতা এখন পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। এর মধ্যে আব্বাস মাহমুদ আল আক্কাদ (রহ.)-এর ‘আল মারআতু ফিল কোরআন’, মোহাম্মদ ফরিদ ওয়াজদী (রহ.)-এর ‘আল মারাআতুল মুসলিমাহ’ এবং ডক্টর আকরাম নদভি (রহ.)-এর ‘মুহাদ্দিসাত’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
মুসলিম নারীদের অবদানের মহাসমুদ্র থেকে কিঞ্চিৎ পরিমাণ মণি-মাণিক্য এখানে সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরা হলো—
উলুমুল কোরআন (কোরআন অধ্যয়নের বিজ্ঞান) : নবীযুগ থেকে এখন পর্যন্ত অসংখ্য নারী এসেছেন, যাঁরা কোরআনের হাফেজ, কারি ও তাফসিরবিদ ছিলেন।
ইমামুল কুররা ইবনে জাজারি (রহ.) তাঁর মেয়ে সালমা সম্পর্কে লিখেছেন, তিনি ‘কিরাতে সাবআ’ অর্থাৎ সাত কিরাতের ওপর কোরআন মুখস্থ করেছিলেন, এমনকি তিনি ‘কিরাতে আশারাহ’ তথা ১০ কিরাতেও তিলাওয়াত করতেন। তিনি তাঁর সময়ের সবচেয়ে বড় কারি, হাফেজ ও উলুমুল কোরআনের পণ্ডিত ছিলেন।
(তবাকাতে মুফাসসিরিন, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১১০)
মুহাম্মদ বিন সিরিন (রহ.)-এর বোন হাফসা বিনতে সিরিন মাত্র ১২ বছর বয়সে তাফসিরসহ কোরআন মুখস্থ করেছিলেন, এমনকি মুহাম্মদ বিন সিরিন (রহ.)-ও এই শাস্ত্রে তাঁর বোনের থেকে জ্ঞানার্জন করতেন। তিনি তাজবিদ ও কিরাত শাস্ত্রেও পারদর্শী ছিলেন।
(তাহজিবুত তাহজিব, খণ্ড-১১, পৃষ্ঠা-৪০৯)
হাদিসশাস্ত্র : যুগে যুগে মুসলিম নারীরা সামর্থ্য ও সুযোগ অনুযায়ী জ্ঞানার্জন করেছেন।
(আল ইকদুস সামিন, খণ্ড-৮, পৃষ্ঠা-২৩)
উম্মে আলী তাকিয়া বিনতে আবুল ফারাজ গিয়াস বিন আলী আস সুরিয়া আল বাগদাদি (রহ.) বাগদাদ থেকে মিসরে যান, সেখানে কিছুকাল অবস্থান করেন এবং ইমাম আবু তাহির আহমদ বিন মুহাম্মদ জুলফি (রহ.)-এর কাছ থেকে বিশেষভাবে জ্ঞানার্জন করেন।
(প্রাগুক্ত, খণ্ড-৮, পৃষ্ঠা-২২১)
উম্মে মুহাম্মদ ফাতিমা বিনতে নাফিসুদ্দিন মুহাম্মদ বিন হুসাইন (রহ.) সিরিয়া থেকে মিসর ও ত্রিপোলি ভ্রমণ করে তাঁর চাচার কাছে হাদিস শিক্ষালাভ করেন। এ ছাড়া তিনি ইলমে হাদিস ও অন্যান্য বিষয়ে বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। (প্রাগুক্ত, খণ্ড-৮, পৃষ্ঠা-২৭৩)
উম্মে মুহাম্মদ জয়নাব বিনতে আহমাদ বিন উমর (রহ.)-এর জন্মভূমি ছিল বায়তুল মাকদিস। ইমাম জাহাবি (রহ.) তাঁকে ‘আল মামারুল রাহিলা’ উপাধিতে ভূষিত করেছেন। কারণ তিনি জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে দূর-দূরান্তের দেশে ভ্রমণ করতেন। এই নারী মুহাদ্দিস যখন কোনো মুহাদ্দিসের দরসে যেতেন, তখন তাঁর জন্য আলাদা ব্যবস্থা থাকত। তবে তিনি সাধারণত নিজের বাড়িতেই হাদিস পড়াতেন আর হাদিসপিপাসু ছাত্ররা সেখানে এসে উপকৃত হতেন। (আল ইবার ফি খাবার মান গাবার, খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা-১২৬)
ইমাম জাহাবি (রহ.) আজিবা বিনতে মুহাম্মদ বিন আবু গালিব আল বাগদাদি (রহ.) সম্পর্কে লিখেছেন, তিনি ১০ খণ্ডে তাঁর শিক্ষক ও ওস্তাদদের জীবনীগ্রন্থ লিখেছেন। (প্রাগুক্ত, খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা-১৯৪)
ফিকাহ ও ফতোয়া : ইবনে কাইয়্যুম (রহ.)-এর ভাষ্য মতে, প্রায় ২২ জন নারী সাহাবি ইসলামী আইনশাস্ত্রে বিখ্যাত ছিলেন। এর মধ্যে সাতজন উম্মাহাতুল মুমিনিন (নবীজির পূতঃপবিত্র স্ত্রী) ছিলেন। আর তাঁদের সবার মধ্যে উম্মুল মুমিনিন আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) ‘ফকিহুল উম্মাহ’ উপাধিতে সুপ্রসিদ্ধ ছিলেন। আলাউদ্দিন সমরকন্দি (রহ.) (৫৩৯ হি.)-এর মেয়ে ফাতিমা ছিলেন জগদ্বিখ্যাত ফকিহ (ইসলামী আইনবিদ)। তিনি তাঁর বাবা ও স্বামীর কাছ থেকে ফতোয়া লেখা শিখেছিলেন। তাঁর স্বামী ইমাম আলাউদ্দিন আল কাসানি (রহ.) (৫৮৭ হি.) ‘বাদায়েউস সানায়ে’ সংকলন ও বিন্যস্ত করার সময় যখন তাঁর ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখা দিত, তখন তিনি তাঁকে সতর্ক ও সংশোধন করে দিতেন।
(আল মুনতাজাম, খণ্ড-৬, পৃষ্ঠা-১৩৯)
ইমাম তাকি উদ্দিন ইব্রাহিম (রহ.)-এর মেয়ে আমাতুর রহমান ফিকাহশাস্ত্রে বিখ্যাত ছিলেন এবং তাঁকে ‘সিত্তুল ফুকাহা’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। (আল ইবার ফি খাবার মান গাবার, খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা-১৪৭)
কবিতা ও সাহিত্য : মুসলিম নারীরাও সাহিত্য ও কাব্যে বিশিষ্ট অবস্থান অর্জন করেছেন। তাঁদের মধ্যে মহান কবি ও সাহিত্যিকও রয়েছেন। এর মধ্যে মরিয়ম বিনতে আবু ইয়াকুব (রহ.) ছিলেন আন্দালুসের একজন বিখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক। তিনি নারীদের কবিতা ও সাহিত্যও শেখাতেন। (বুগয়াতুল মুলতামিস, পৃষ্ঠা-৫২৮)
অনুরূপভাবে বিখ্যাত মুহাদ্দিস জয়নাব বিনতে কামাল হাশমি (রহ.) ছিলেন মক্কার বুদ্ধিজীবী নারীদের একজন; সেই সঙ্গে কবিতার প্রতি অনুরাগীও ছিলেন। (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৫২৯)
এ ছাড়া আন্দালুসের কবিদের মধ্যে গাসসানিয়াহ, ওয়াদি আশিয়া, নাজহুন প্রমুখ নারী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৫৩০-৩৬)
ক্যালিগ্রাফার ও লেখিকা : ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান বিকাশের সময়কালে অসংখ্য মুসলিম নারীর কথা উল্লেখ রয়েছে, যাঁরা জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রচার ও বিকাশে কোনো অংশেই কম ভূমিকা পালন করেননি। লেখালেখি ও ক্যালিগ্রাফিতেও তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এর মধ্যে ফখরুন নিসা শহিদা বিনতে আহমদ (রহ.) লেখিকা হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। কারণ তিনি ভালো ও সুন্দর লিখতেন।
(আল মুনতাজাম, খণ্ড-১০, পৃষ্ঠা-২৮৮)
উম্মুল ফজল ফাতিমা বিনতে হাসান বিন আলী আল ইকরা (রহ.) ছিলেন বাগদাদের একজন বিখ্যাত ও সুপরিচিত লেখিকা। ইমাম জাহাবি (রহ.) বলেন, ফাতিমার সুন্দর হস্তলিপি দেখে দেখে মানুষ লেখা শিখত আর তিনি বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার ইবনুল বাওয়াবের লেখা হুবহু নকল করতেন।
(আল ইবার ফি খাবার মান গাবার, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-২৯৬)
অনুরূপভাবে আমাতুল আজিজ খাদিজা বিনতে ইউসুফ (রহ.) ছিলেন একজন আলেমা, পণ্ডিত ও মুহাদ্দিস। তিনি ক্যালিগ্রাফির জন্যও বিখ্যাত ছিলেন। ইমাম জাহাবি (রহ.) বলেন, তিনি ক্যালিগ্রাফারের একটি দল থেকে ক্যালিগ্রাফি শিখেছেন। (প্রাগুক্ত, খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা-৩৯৮)
এ ছাড়া বহু মুসলিম নারীর কথা উল্লেখ আছে, যাঁরা বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ ও বিজ্ঞ ছিলেন।