মসজিদ হলো আল্লাহ তাআলার নিদর্শন ও ইসলামের প্রতীক। ইসলামের প্রতীককে সম্মান দেখানো ঈমানের দাবি। এ বিষয়ে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘যে আল্লাহর নিদর্শনকে সম্মান করে, নিঃসন্দেহে তা অন্তরের তাকওয়া থেকেই।’ (সুরা : হজ, আয়াত : ৩২)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘এসব মসজিদ বানানো হয়েছে আল্লাহর স্মরণ ও আলোচনা, নামাজ ও কোরআন পাঠের জন্য।
(মুসলিম, হাদিস : ২৮৫)
মসজিদে উচ্চৈঃস্বরে কথা বলা নিষিদ্ধ
মসজিদে উচ্চৈঃস্বরে কথা বলা মসজিদের আদব ও সম্মানবহির্ভূত কাজ। সুতরাং এটি নিষিদ্ধ। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা তোমাদের মসজিদকে অবুঝ শিশু ও পাগলদের থেকে দূরে রাখো, তদ্রূপ ক্রয়-বিক্রয়, বিচার-আচার, উচ্চৈঃস্বর, দণ্ড প্রদান ও তরবারি কোষমুক্ত করা থেকে বিরত থাকো।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৭৫০)
একটি হাদিসে মসজিদে উচ্চ আওয়াজ ও চেঁচামেচি কিয়ামতের নিদর্শন হিসেবে উল্লিখিত হয়েছে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যখন লোকেরা জিহাদলব্ধ গনিমতের সম্পদকে নিজের সম্পত্তি বুঝবে, আমানতকে স্বীয় সম্পত্তি গণ্য করবে, জাকাতকে জরিমানা মনে করবে, দ্বিনি ইলম ছাড়া অন্য ইলম শিক্ষা করবে, পুরুষ স্ত্রীর তাঁবেদারি করবে, নিজ মায়ের নাফরমানি করবে, বন্ধুবান্ধবকে ঘনিষ্ঠ ভাববে আর আপন পিতাকে দূরবর্তী বলে বুঝবে, মসজিদে উচ্চৈঃস্বর ও চেঁচামেচি বেড়ে যাবে, ফাসেক লোক সমাজের সর্দার হবে, সর্বাপেক্ষা নীচ প্রকৃতির লোক সমাজের কার্যভারপ্রাপ্ত হবে, জালিমকে তার জুলুমের ভয়ে লোক সম্মান করবে, নর্তকী ও বাদ্যযন্ত্র বিস্তার লাভ করবে, মদ প্রচুর পরিমাণে পান করা হবে, পরবর্তী লোকেরা পূর্বপুরুষকে মন্দ বলবে, তখন তোমরা এরূপ বিপদের অপেক্ষা করতে থাকবে যে লালবর্ণ প্রচণ্ড বায়ু অথবা ভূমিকম্প, জমিন ধসে যাওয়া, লোকের রূপান্তর হওয়া, পাথর বর্ষণ হওয়া ইত্যাদি পরিলক্ষিত হবে। আরো অনেক আপদ-বিপদ এমনভাবে ধারাবাহিক আসতে থাকবে, যেমন মুক্তামালা ছিঁড়ে গেলে দানাগুলো খসে পড়তে থাকে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২২১০ ও ২২১১)
মসজিদে হারানো বিজ্ঞপ্তি নিষিদ্ধ
মসজিদে হারানো বা প্রাপ্তির ঘোষণা করা নিষিদ্ধ। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) মসজিদে ক্রয়-বিক্রয়, হারানো বিজ্ঞপ্তি, কবিতা আবৃত্তি নিষিদ্ধ করেছেন।
(আবু দাউদ, হাদিস : ১০৭৯)
অপর বর্ণনায় রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা যখন কাউকে মসজিদে হারানো বিজ্ঞপ্তি দিতে শোনো, তখন বলবে, আল্লাহ তোমার হারানো বস্তু ফিরিয়ে না দিক, কেননা মসজিদ তো এ জন্য বানানো হয়নি।’
(সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৫৬৮)
সমন্বিত জিকিরের ক্ষেত্রেও সতর্কতা কাম্য
আলেমারা মসজিদে উচ্চৈঃস্বরে জিকিরের ক্ষেত্রেও সতর্ক করেছেন যে উচ্চৈঃস্বরে জিকিরের কারণে নামাজি, তিলাওয়াতকারী, অন্য ইবাদতকারী ও ইতিকাফকারীদের ঘুমের যেন ব্যাঘাত না হয়। নচেৎ উচ্চৈঃস্বরে জিকিরও নিষিদ্ধ হবে।
(রদ্দুল মুহতার : ১/৬৬০,
ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়া : ৬৩৯)
মসজিদে পার্থিব কথাবার্তার বৈধতার সীমা
নামাজ ও ইবাদতের উদ্দেশ্যে মসজিদে গমনের পর অবসরে মুসল্লিদের ব্যাঘাত না করে পরস্পর স্বাভাবিক আওয়াজে পার্থিব বৈধ কথাবার্তা বলা জায়েজ। রাসুলুল্লাহ (সা.) ফজরের নামাজের পর নামাজের স্থান থেকে সূর্যোদয়ের পূর্বে উঠতেন না।
এ অবস্থায় মুসল্লি সাহাবিরা পরস্পর স্বাভাবিক আওয়াজে কথাবার্তা বলতেন এবং জাহেলি যুগের গল্প করে হাঁসতেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-ও তাঁদের গল্প শুনে মুচকি হাঁসতেন।
(মুসলিম, হাদিস : ৬৭০)
তবে শুধু পার্থিব কথাবার্তা বলার উদ্দেশ্যেই মসজিদে গমন এবং আসর জমানো নাজায়েজ। (রদ্দুল মুহতার : ১/৬৬২, ফাতাওয়ায়ে
হিন্দিয়া : ৫/৩২১)
দুটি জাল বর্ণনা
মসজিদে পার্থিব কথাবার্তার নিষিদ্ধতার ব্যাপারে সমাজে দুটি জাল বর্ণনা প্রচলিত রয়েছে।
এক. ‘মসজিদে পার্থিব কথাবার্তার কারণে অর্জিত পুণ্যগুলো এমনভাবে ধ্বংস হয়ে যায়, যেভাবে আগুন কাষ্ঠখড়িকে জালিয়ে ভষ্ম করে দেয়।’ হাদিসবিশারদরা এটিকে ভিত্তিহীন ও জাল বলে উল্লেখ করেছেন। (তাজকিরাতুল মওদুয়াত,
পৃষ্ঠা-৩৬, আল মওদুআতুল কুবরা : ১৮৬)
দুই. ‘মসজিদে পার্থিব কথাবার্তায় লিপ্ত ব্যক্তিদের ফেরেশতারা প্রথমে এই বলে নিষেধ করেন, হে আল্লাহর বন্ধু! কথা বন্ধ করো। তার পরও কথা বললে দ্বিতীয়বার বলেন, হে আল্লাহর বান্দা! কথা বন্ধ করো। তার পরও কথা বললে তৃতীয়বার বলেন, হে আল্লাহর দুশমন! কথা বন্ধ করো।’
উক্ত বর্ণনাটিও হাদিসের কোনো গ্রন্থে পাওয়া যায় না বিধায় ওলামায়ে কিরাম এটিকে জাল বলে আখ্যা দিয়েছেন।
এ আলোচনা থেকে বোঝা যায়, মসজিদে পার্থিব কথা বলার ক্ষেত্রে ইসলামের নীতি ভারসাম্যপূর্ণ। মসজিদে একেবারেই কোনো কথা বলা যাবে না, বিষয়টি এমন নয়। আবার অবলীলায় মসজিদে কথা বলা যাবে, তাও নয়। বরং শর্তসাপেক্ষে মসজিদে বিশেষ প্রয়োজনে কথা বলা যাবে।