ক্ষণগণনা শেষ হলেও রাজধানীর বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প শেষের দিনক্ষণ বারবার পিছিয়েই যাচ্ছে। আগামী ডিসেম্বরে প্রকল্পটির উদ্বোধন করার সময় ঠিক করাই ছিল। প্রকল্পের সার্বিক কাজের ভৌত অংশের অগ্রগতি প্রায় শতভাগ। এখন বলা হচ্ছে, এই প্রকল্পে যে বিশেষ বাস পরিচালনা করা হবে সেগুলোই কেনা হয়নি। মাঝখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে প্রকল্পের প্রায় শত কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে। জুলাইয়ের মধ্যভাগে বন্ধ হয়ে যাওয়া কাজ গত তিন মাসেও শুরু করা যায়নি। এই পরিস্থিতিতে প্রকল্পটির মেয়াদ সপ্তমবারের মতো আরও দুই বছর বাড়ানোর প্রস্তাব যাচ্ছে সরকারের কাছে। একই সঙ্গে ব্যয় বাজেটও বেড়ে যাবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত প্রকল্পের মালামাল আগে কেনা হয়েছিল ৮০ টাকা ডলার রেটে। সেটা এখন কিনতে হবে ১২০ টাকা রেটে। 


ঢাকা-গাজীপুর রুটের যাত্রীদের নিত্যদিনের দুর্ভোগ থেকে স্বস্তি দিতে প্রকল্পটি নেওয়া হলেও এক যুগ ধরে যানজটসহ নানা ভোগান্তির শিকার সাধারণ যাত্রীরা। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে নির্মাণকাজের কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকতে হতো যাত্রীদের। বর্তমানে প্রকল্পের বড় অংশে মিশ্র যানবাহন চলাচল করায় যাতায়াত সহজ হলেও স্টেশন এলাকাগুলোয় দুই পাশের সড়ক সংকুচিত হয়ে যাওয়ায় বিভিন্ন পয়েন্টে যানজট বাড়ছে। রাস্তার মাঝপথে স্টেশনে যাওয়ার ওভারব্রিজ তৈরির কারণে ফুটপাত সংকুচিত হয়ে পড়েছে।


ঢাকার উত্তরাংশের যানজট নিরসনে ২০ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত ২০১২ সালে নেওয়া প্রকল্পটির মেয়াদ চলতি বছরের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা ছিল। এক যুগ আগে প্রকল্পের শুরুতে এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। কয়েক দফায় সময় ও বরাদ্দ বাড়িয়ে প্রকল্পের সর্বশেষ ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা। প্রকল্পটিতে ঋণ সহায়তা দিচ্ছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি), এজেন্সি ফ্রান্সিস দ্য ডেভেলপমেন্ট (এএফডি) এবং গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি (জিইএফ)।

আন্দোলনে ক্ষতি নিরূপণ : প্রকল্পটির তত্ত্বাবধায়ক প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিআরটি কোম্পানির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, সাম্প্রতিক আন্দোলনে প্রকল্পটির বিভিন্ন অংশের অবকাঠামো ও নির্মাণাধীন বাস স্টেশনসহ বিভিন্ন স্থাপনায় ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে আগুনে ভস্মীভূত হয়েছে দুটি লিফট, দুটি জেনারেটর, পানির লাইন ও ইউটিলিটি সংযোগ। প্রকল্পের সাইট অফিস ও নির্মাণকাজে ব্যবহৃত বিশেষায়িত যানবাহন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর বাইরে আরও ১,১০০ বর্গমিটার ওয়াল টাইলস, ২,০০০ বর্গমিটার এসএস রেলিং, ২,৫০০ বর্গমিটার শেড, ৬০০ মিটার পাইপ, চারটি ওয়েল্ডিং মেশিন, দুটি পানির ট্যাংক, দুই এক্সক্যাভেটর, দুটি রোড কাটিং মেশিনসহ বিভিন্ন স্থাপনা ও দামি যন্ত্রাংশের ক্ষতি হয়েছে। তিনি বলেন, প্রকল্পের মোট ৫৭টি এস্কেলেটর-এর মধ্যে ৩৮টি এস্কেলেটর আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২৯টি, এ ক্ষেত্রেই আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৫৫ কোটি টাকারও বেশি।


অবশ্য আন্দোলনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ গত আড়াই মাসেও বিআরটি কর্তৃপক্ষ নিজেরা হিসাব করতে পারেনি। ঢাকা বিআরটি কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ক্ষয়ক্ষতির হিসাব প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে করা হয়েছে। ফলে এটি একটি আনুমানিক হিসাব, চূড়ান্ত কিছু নয়। আমরা এ হিসাব মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দিয়েছি। যাচাই শেষে এ বিষয়ে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, প্রকল্পটির কাজ আবারও শুরু করতে ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটির মেয়াদ ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিল। এ মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে। আমাদের মূল বিআরটি করিডরের কাজ প্রায় শেষ। এখন আমরা বাস কেনার উদ্যোগ নিয়েছি। বাসগুলো বহরে যোগ হওয়ার পরই বিআরটি পরিষেবা চালু করা হবে। প্রকল্পের বাকি কাজ শেষ করে এই রুটটি চালু হলে দ্রুত যোগাযোগে বড় ভূমিকা রাখবে।


প্রকল্পের রুট : বিআরটির ২৫টি স্টেশনেরই অবকাঠামো নির্মাণকাজ শেষ। স্টেশনে ওঠার লিফটগুলো বসানো হয়নি। এস্কেলেটরগুলো রাস্তায় রাখা ছিল। এগুলোই আন্দোলনের আগুনে পুড়েছে। ২৫টি স্টেশন হচ্ছে, বিমানবন্দর টার্মিনাল, জসীমউদ্দীন সরণি, আজমপুর, হাউস বিল্ডিং, আবদুল্লাহপুর, টঙ্গী ব্রিজ, স্টেশন রোড, মিল গেট, চেরাগ আলী মার্কেট, টঙ্গী কলেজ, হোসেন মার্কেট (এরশাদ নগর), গাজীপুরা, তারগাছ, বড়বাড়ী বাজার, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, বোর্ডবাজার, হাজীর পুকুর, মালেকেরবাড়ী, ভোগরা দক্ষিণ, ভোগরা উত্তর, চৌরাস্তা, বিআরটিসি ডিপো, আড়ং মিল্ক ফ্যাক্টরি, কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং গাজীপুর টার্মিনাল।


অনেক প্রশ্নের জবাব নেই : রাজধানীর বড় দুর্ভোগের অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প বিআরটি নিয়ে অনেক প্রশ্নের জবাব মিলছে না। বিদ্যমান সড়কের মাঝখান দিয়ে বড় অংশজুড়ে বিআরটি লাইন নির্মাণের কারণে দুই পাশের সড়ক সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। শত সিঁড়ি ডিঙিয়ে রাস্তার মাঝখানে নির্মিত বাসস্টপে গিয়ে টিকিট কেটে বাসে উঠতে হবে যাত্রীদের। অথচ রাস্তার পাশে দাঁড়ালেই সিটি পরিবহনের অন্য বাসে উঠতে পারেন যাত্রীরা। বিদ্যমান এ সুবিধা ছেড়ে শত সিঁড়ি ভেঙে কেন বিআরটির বাসে চড়বেন- তার কোনো জবাব নেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে। অন্যদিকে গাজীপুর কিংবা অন্য এলাকা থেকে যারা বাসে যাতায়াত করেন তাদের অধিকাংশেরই কাজ রাজধানীর ফার্মগেট, মতিঝিল, পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন অংশে। বিমানবন্দর এলাকায় তাদের কোনো কাজ নেই। এসব যাত্রীকে বিমানবন্দরে নেমে আবার বাস ধরে নিজেদের গন্তব্যে যেতে হবে। যোগাযোগ ও পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ত্রুটিপূর্ণ পরিকল্পনায় নির্মিত বিআরটি প্রকল্পের পরিপূর্ণ সুফল পাওয়া যাবে না।


কাজ বন্ধ তিন মাস : সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে অর্থায়নের সংকট না থাকলেও এখন প্রকল্প শেষ না হওয়ার পেছনের কারণ হচ্ছে ১৮ থেকে ২০ জুলাইয়ে আন্দোলনের সময় অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটে ক্ষতিগ্রস্ত নির্মাণসামগ্রী। এখন সেগুলো পুনরায় আমদানি করা হলে তবেই আবার কার্যক্রম শুরু হবে। জুলাইয়ের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম একটি বড় কেন্দ্র ছিল ঢাকার উত্তরা এলাকা। তখন আন্দোলনে উত্তাল ছিল এই মহাসড়কের আশপাশ। তখন অনেক সরকারি স্থাপনাতেও আগুন দিয়েছিল ছাত্র-জনতা। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ওপর এক যুগেরও বেশি সময় ধরে গড়ে তোলা হচ্ছে বিআরটি প্রকল্প।


বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. শামছুল হক বলেন, বিআরটি প্রকল্প যেভাবে পরিচালনা করার কথা, সেভাবে পরিচালনা না হলে এখানে যানজট বাড়বে। করিডরের জন্য বিশেষায়িত বাস না কিনে সাধারণ বাস চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দিলেই বরং ভালো হবে। বিআরটি একটি খন্ডিত প্রকল্প হলেও এখানে গাড়ি চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ায় যানজট থেকে স্বস্তি মিলেছে। দীর্ঘসময় ও অতিরিক্ত খরচে বিআরটি প্রকল্প রেকর্ড করেছে। সরকারের এই উদ্যোগকে বিআরটি না ভেবে এখন যদি করিডর উন্নয়ন চিন্তা করা হয়, তাহলে তা সফল হবে।


উল্লেখ্য, যাত্রী পরিবহনের জন্য বিশ্বজুড়ে বিআরটি সুপরিচিত। বিশ্বের অনেক দেশে এই প্রকল্প বাস্তবায়নকাল ছয় মাস থেকে দেড় বছর। কিন্তু আমাদের এখানে প্রকল্পের ব্যয় বাড়াতে অসংখ্য অপ্রয়োজনীয় ফ্লাইওভার তৈরি করা হয়েছে। যার ফলে সময় ও অর্থের অপচয় হয়েছে। মানুষ কার্যকর সুফল পাচ্ছে না।