ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নানামুখী তৎপরতার পরও জলাবদ্ধতা থেকে রাজধানীবাসীকে নিষ্কৃতি দেওয়া গেল না। ফলে এ বর্ষায়ও নগরবাসীর নিত্যসঙ্গী হয়েই রইল জলজট। বিগত এক যুগে সেবা সংস্থাগুলো ঢাকার জলজট নিরসনে খাল, ড্রেনেজ, নর্দমা পরিষ্কার ও উন্নয়নের নামে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ করে ফেলেছে। জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ থেকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব হয়নি ঢাকাবাসীকে। এ মেগাসিটির বিদ্যমান ড্রেনেজব্যবস্থায় ঘণ্টায় ৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে পানি সরতে লাগছে ১২ ঘণ্টা।


ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে ২৭ মে রাজধানীতে থেমে থেমে দিনভর বৃষ্টি হয়। ওই দিন ১২ ঘণ্টায় ১৪৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। ওই বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় ধানমন্ডি, কলাবাগান, মিরপুরসহ পুরো ঢাকা শহর। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কুইক রেসপন্স টিমসহ নানা কার্যক্রম হাতে নিলেও দুই দিনেও সড়ক থেকে পানি সরাতে পারেনি। অথচ গত এক যুগে ঢাকা ওয়াসা ও দুই সিটি করপোরেশন খাল, নর্দমা, ড্রেন সংস্কার, উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের নামে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে। তবু জলজটের সুরাহা হচ্ছে না। উপরন্তু নতুন নতুন এলাকায় জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে।


ঢাকা মহানগরীর প্রধান প্রধান ড্রেনলাইন নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল ঢাকা ওয়াসার। শাখা লাইনগুলোর দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের ওপর ন্যস্ত ছিল। ওই সময় রাজধানীর মোট ড্রেনেজ লাইনের মধ্যে ৩৮৫ কিলোমিটার ঢাকা ওয়াসা এবং ২ হাজার ৫০০ কিলোমিটার ঢাকা সিটি করপোরেশনের অধীনে ছিল। এর বাইরে ৭৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ২৬টি খাল ও ১০ কিলোমিটার বক্স কালভার্টের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও ছিল ঢাকা ওয়াসার। যে কারণে বর্ষায় সৃষ্ট জলাবদ্ধতা নিরসনে সংস্থাগুলো একে অন্যের ওপর দায় চাপানোর সুযোগ পেত। কিন্তু ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ওয়াসার দায়িত্বে থাকা সব নালা ও খাল দুই সিটি করপোরেশনকে হস্তান্তর করা হয়। দায়িত্ব ছাড়ার আগে ঢাকা ওয়াসা রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ২০৩ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়। যার মেয়াদ শেষ হয় ২০১১ সালে। কিন্তু এ প্রকল্পে রাজধানীবাসী কোনো সুফল পায়নি। দ্বিতীয় ধাপে ২৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে আরও একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। সব মিলিয়ে ২০২০ সাল পর্যন্ত নয় বছরে জলাবদ্ধতা নিরসনে ঢাকা ওয়াসা ব্যয় করেছে ২ হাজার ২৫ কোটি টাকা। ঢাকা ওয়াসা ছাড়াও ড্রেনেজ খাতের উন্নয়নে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫৭৩ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। পরের দুই বছরে ব্যয় করেছে আরও ৪০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া গত দুই বছর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ১৬১টি জলাবদ্ধ স্থান নির্ধারণ করে ১০৯টি স্থানে জলাবদ্ধতা নিরসনে ২৫২ কোটি খরচ করেছে। ফলে এভাবে নানা সময় ঢাকা ওয়াসা, সিটি করপোরেশন জলাবদ্ধতা নিরসনে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় করেছে; কিন্তু নগরবাসী কোনো সুফল পায়নি।


এ ছাড়া জলাবদ্ধতা নিরসনে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন লেক রক্ষণাবেক্ষণ খাতে খরচ করেছে ৫ কোটি, ড্রেন ক্লিনিং খাতে ৫ কোটি ও খাল পরিষ্কারে ৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া পাম্প হাউসের যন্ত্রপাতি আধুনিকীকরণ, উন্নয়ন বাবদ খরচ করেছে ২৫ কোটি টাকা। অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জলাবদ্ধতা দূরীকরণে খরচ করেছে ৯০ কোটি টাকা। বুড়িগঙ্গা চ্যানেল খননকাজে ৩০ কোটি টাকা। এ ছাড়া ‘খাল পুনরুদ্ধার, সংস্কার ও নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টি’ নামের প্রকল্পে ব্যয় করেছে ২০৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা।


এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, ‘ঢাকার জলাবদ্ধতার মূল কারণ ঢাকার উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ বলতে কিছু নেই। আরবান গভর্ন্যান্স ও উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ-এ দুটি যদি না থাকে তাহলে যতই খাল উদ্ধার আর খালের ময়লা পরিষ্কার করা হোক না কেন, তাতে কাজ হবে না। ঢাকায় প্রচুর ভবন হচ্ছে, খাল দখল করে রাস্তা হচ্ছে। নগরীর ধারণক্ষমতার তুলনায় ভবন ও মানুষের সংখ্যা ৩ থেকে ৪ গুণ হয়ে গেছে। এখনো ঢাকা ঘিরে উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণের কোনো প্রচেষ্টা নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘পানি আন্ডারগ্রাউন্ডে যাওয়ার জন্য যে মাঠ বা সবুজ এলাকা দরকার তা নেই। জলাশয়ও ভরাট হয়ে যাচ্ছে। যেমন হাতিরঝিলে একটা অংশ, বিমানবন্দর এলাকার একটা অংশও ভরাট করা হয়েছে। বিএডিসিও জায়গা ভরাট করেছে। একই সঙ্গে কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ বাড়ায় ঢাকা ডুবছে।’ এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘বিগত বছরের তুলনায় এবার কম হবে জলাবদ্ধতা। ইতোমধ্যে ২৬১টি জলাবদ্ধপ্রবণ এলাকার মধ্যে ২০৯টি স্থানে অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন কাজ শেষ হয়েছে। এসব এলাকায় এবার জলাবদ্ধতা হবে না। তবে হাতিরঝিল ভরাটের কারণে ধানমন্ডি, পান্থপথ ও কলাবাগান এলাকায় কিছুটা জলাবদ্ধতা হতে পারে।’