প্রভাবশালী ব্রিটিশ গণমাধ্যম ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ক্ষমতা হারানো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা তাঁর শাসনামলে একটি গোয়েন্দা সংস্থার কিছু সদস্যের সঙ্গে যোগসাজশ করে ব্যাংক খাত থেকে ১৭ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ সরিয়েছেন।
সাক্ষাৎকারটি গতকাল ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসে ‘বাংলাদেশ সেন্ট্রাল ব্যাংকার একিউসেস টাইকন্স অব “রবিং ব্যাংকস” অব ডলার ১৭ বিএন উইথ স্পাই এজেন্সি হেল্প’ শিরোনামে প্রকাশ পায়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আরও বলেন, ‘যে কোনো বৈশ্বিক মানদণ্ডে এটি সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে ব্যাপক ব্যাংক ডাকাতি। এ মাত্রায় (ব্যাংক ডাকাতি) অন্য কোথাও হয়নি।’
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলমের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম ও তাঁর সহযোগীরা ‘অন্তত’ ১০ বিলিয়ন বা ১ হাজার কোটি ডলার ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ‘বের করে নিয়েছেন’। তাঁর মতে, ‘তাঁরা প্রতিদিনই নিজেদের জন্য ঋণ অনুমোদন করেছেন।’ প্রতিবেদনে বলা হয়, সাইফুল আলমের পক্ষে আইনি প্রতিষ্ঠান কুইন এমানুয়েল আরকুহার্ট অ্যান্ড সুলিভান একটি বিবৃতি দিয়েছে। তাতে এস আলম গ্রুপ জানিয়েছে, গভর্নরের অভিযোগের ‘কোনো সত্যতা নেই’। এতে বলা হয়, ‘এস আলম গ্রুপ ও বাংলাদেশের আরও কিছু শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তী সরকারের সমন্বিত প্রচারণা এমনকি যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করার মৌলিক নীতির প্রতি সম্মান দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে।’
ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর মন্তব্যের জন্য তাদের অনুরোধে সাড়া দেয়নি এবং ডিজিএফআইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
আহসান এইচ মনসুর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) একজন সাবেক কর্মকর্তা। গত মাসে তিনি ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেছিলেন যে, শেখ হাসিনার সহযোগীদের বিদেশে থাকা সম্পদের বিষয়ে তদন্ত করতে তিনি যুক্তরাজ্য সরকারের সহায়তা কামনা করেছেন। ব্যাংক খাত নিয়ে তাঁর সর্বশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, শেখ হাসিনার শাসনামলে ব্যাংকের পরিচালকদের লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়েছিল।
গভর্নর বলেন, গোয়েন্দা সংস্থার তৎকালীন কিছু সদস্য ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের ‘তাদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে আসে’ এবং এরপর হোটেলের মতো জায়গায় নিয়ে যায়। এরপর ‘অস্ত্রের মুখে’ তাঁদের শেয়ার ‘মি. এস আলমের কাছে’ বিক্রির জন্য এবং তাঁদের পরিচালকের পদ ছাড়তে বলেন। তাঁর কথায়, ‘একের পর এক ব্যাংকের ক্ষেত্রে তাঁরা এটা করেছেন।’ একটি ব্যাংকের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেছেন, জোর করে ব্যাংক দখলের প্রক্রিয়ায় তাঁকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। ইসলামী ব্যাংকের সাবেক প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ আবদুল মান্নান বলেন, ২০১৩ সালে ‘তৎকালীন সরকারের সঙ্গে জড়িত লোকেরা’ তাঁর ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। এর মধ্যে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের পরামর্শমতো পরিচালক নিয়োগ এবং ব্যাংকের একজন বিদেশি পরিচালকের হোটেল রুমে ‘সরকারি সংস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিদের’ দ্বারা তল্লাশি চালানো। মোহাম্মদ আবদুল মান্নান বলেন, ২০১৭ সালে তিনি যখন ব্যাংকের পর্ষদ সভায় যাচ্ছিলেন, তখন তাঁকে একজন জ্যেষ্ঠ প্রতিরক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং এরপর পুরো একটি দিন তাঁকে আটকে রেখে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। তিনি আরও বলেন, ‘তাঁরা ব্যাংকের জাল কাগজপত্র তৈরি করেছিলেন। আমাকে শেষ পর্যন্ত একটি পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করতে হয়েছিল।’ গত সেপ্টেম্বরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মোহাম্মদ আবদুল মান্নানকে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে।
গত দশকে এস আলম গ্রুপ ব্যাংকিং ব্যবসায় নাম লিখিয়েছে। গ্রুপের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, সাতটি ব্যাংকে তাদের ‘উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিনিয়োগ’ রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক। আহসান এইচ মনসুর তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেন, শেখ হাসিনার সময়ে দখল করা হয়েছিল এমন প্রায় ১২টি ব্যাংকের অবস্থা নিরীক্ষা করার পর বাংলাদেশ চুরি হওয়া অর্থ উদ্ধারের পদক্ষেপ নেবে। তিনি বলেন, ‘আমরা এ নিরীক্ষা প্রতিবেদন দেশে ও দেশের বাইরের আদালতে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করতে চাই।’ প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার এসব ব্যাংকের শেয়ার বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংকগুলোর শেয়ার ‘ভালো মানের দেশি ও আন্তর্জাতিক কৌশলগত বিনিয়োগকারীদের’ কাছে বিক্রি করে সেগুলো পুনরর্থায়নের জন্য কর্তৃপক্ষ পরিকল্পনা করেছে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর খারাপ হয়ে পড়া সম্পদের ব্যবস্থাপনা ও নিষ্পত্তি করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি গঠন করারও পরিকল্পনা করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেন, লোপাট হওয়া ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডাররা দেশ থেকে যে অর্থ দুবাই, সিঙ্গাপুর বা অন্যান্য স্থানে পাচার করে নিজেদের আয়ত্তে রেখেছেন, তা উদ্ধারের চেষ্টায় আন্তর্জাতিক আইন প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হবে।