ঢাকার বায়ুতে ভয়ংকর বিষ ছড়িয়ে পড়েছে। শীত আসতে প্রতিবছরই ঢাকার বায়ু মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে পড়ে। দূষণের এই মাত্রা এতটাই খারাপ পর্যায়ে পৌঁছায় যে, মাসের বেশির ভাগ দিনই এখন বায়ুর মান থাকছে ‘অস্বাস্থ্যকর’ মাত্রার। পরিবেশ অধিদপ্তরের ডেইলি এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স রিপোর্ট অনুযায়ী চলতি নভেম্বর মাসের ২৫ দিনের মধ্যে ১৯ দিনই ঢাকার বায়ু ছিল অস্বাস্থ্যকর। এর মধ্যে পাঁচ দিন ছিল খুবই অস্বাস্থ্যকর। আর বাকি দিনগুলোতে ঢাকার বায়ু ছিল সতর্কীকরণ পর্যায়ে এবং মধ্যম মানের। অর্থাৎ চলতি মাসের এখন পর্যন্ত এক দিনও ঢাকার বায়ুর মান নির্মল ছিল না।


বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শীতকালে সারা বছরের প্রায় ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ বায়ুদূষণ হয়। নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ- এই পাঁচ মাসে মূল বায়ুদূষণ ঘটে। আর বায়ুদূষণের ১২ থেকে ১৫ শতাংশ হয়ে থাকে জুন থেকে অক্টোবর- এই পাঁচ মাসে। শীতকালে দেশের উত্তর দিক থেকে অর্থাৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে ‘ট্রান্স বাউন্ডারি এয়ার পলিউশন’ বায়ুদূষণের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। আর স্থানীয়ভাবে আমাদের ইটভাটা ও শিল্পকারখানাগুলোর নির্মাণকাজ, বর্জ্য পোড়ানোর কাজগুলো শীতে একযোগে শুরু হয়। এ সময়ে যেহেতু বৃষ্টিপাত কম থাকে, সবকিছু শুকনা অবস্থায় থাকে, এজন্য বায়ুদূষণের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।


সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের তথ্যে বিশ্বের ১২৫টি শহরের মধ্যে গত ২৬ নভেম্বর বিকাল ৫টায় বায়ুদূষণে ঢাকার অবস্থান ছিল ষষ্ঠ। এদিন আইকিউএয়ারের বাতাসের মানসূচকে ঢাকার স্কোর ছিল ১৫৬। আর বায়ুম লীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) কর্তৃক সংগৃহীত ২০১৬ থেকে ২০২৪ সালের অর্থাৎ ৯ বছরের নভেম্বর মাসের প্রাপ্ত ২৪৫ দিনের তথ্যউপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত ৯ বছরের নভেম্বর মাসের মোট ২৪৫ দিনের মধ্যে ১৩৮ দিন ছিল ‘অস্বাস্থ্যকর’ এবং ৫৬ দিন ছিল ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’। গত ৯ বছরের নভেম্বর মাসের মোট ২৪৫ দিনের মধ্যে ঢাকার মানুষ মাত্র এক দিন ভালো বা নির্মল বায়ুতে নিঃশ্বাস নিতে সক্ষম হয়েছিলেন।  


স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান এবং ক্যাপস-এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শীতকালে বায়ুদূষণ কমানোর জন্য আমরা একটি শীতকালীন মহাপরিকল্পনা প্রস্তাব করে এসেছি অনেক দিন ধরে। এ ক্ষেত্রে ‘ওড নম্বর’ ও ‘ইভেন নম্বরে’ যানবাহন চালানোর বিষয়ে উল্লেখ করেছি। বিশেষ করে ডিসেম্বরের শেষের দিকে বায়ুদূষণ খুব বেশি বেড়ে যায়। এ সময় সব স্কুল-কলেজ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে। বিভিন্ন জায়গায় নির্মাণকাজগুলোও যাতে নির্মাণবিধি মেনে চলে। যানবাহন, যেগুলোর ফিটনেস নেই সেগুলো যেন কোনোভাবেই এ মৌসুমে রাস্তায় চলতে না পারে। বর্জ্য পোড়ানো যাতে না হয়, সে পদক্ষেপও নিতে হবে।  


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. আতিকুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি মানুষ শ্বাসতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এর মধ্যে আছে হাঁচি, কাঁশি এবং শ্বাসকষ্ট। এজন্য নতুন করেও অনেকে শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হচ্ছে। আবার ধূলিকণার মধ্যে অনেক জীবাণু মিশে থাকে। এর ফলে বিভিন্ন ধরনের ইনফেকশন এবং শিশু-বয়স্কদের নিউমোনিয়া হচ্ছে। বাতাসের মান খারাপ হলে শিশু ও বয়স্করা খুব প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে যেন না যায়। ঘরের বাইরে গেলে অবশ্যই সব বয়সিদের মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। সুষম খাবার খেতে হবে এবং ইনফøুয়েঞ্জা ও নিউমোনিয়ার টিকা নিতে হবে। পরিমিত বিশ্রাম ও কিছু শারীরিক ব্যায়াম করতে হবে। এতে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।


পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) মো. জিয়াউল হক গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বছরের এই সময়টিতে বায়ুর মান বেশি খারাপ হয়ে যায়। সরকার অবৈধ ইটভাটাগুলো আগে বন্ধ করবে। এ ক্ষেত্রে ঢাকার চারপাশে যে অবৈধ ইটভাটা আছে সেগুলোতে মনোযোগ বেশি দেওয়া হবে। একই সঙ্গে নতুন কোনো ইটভাটাকে আর ছাড়পত্র দেওয়া হবে না। বিশেষ করে অবৈধ যে ইটভাটাগুলো বন্ধ করা হবে সেগুলো যেন নতুন করে আর চালু হতে না পারে সেটি দেখা হবে। পুরনো বাস ও ট্রাক যেগুলোর ফিটনেস সার্টিফিকেট নেই এবং ইকোনমিক লাইফ শেষ সেগুলো রাস্তা থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে। পরিবেশ উপদেষ্টা সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির ফলে যে দূষণ হচ্ছে তা কমানো নিয়েও কাজ করবেন। এ ছাড়া কঠিন যে বর্জ্য স্তূপ করে পোড়ানো হয় সেটিও বন্ধ করার চেষ্টা চলছে।