জীবন মানের একটু পরিবর্তনের আশায় নানা স্বপ্ন নিয়ে প্রবাসে যান তাঁরা। গায়ে খেটে, অমানুষিক পরিশ্রম করে রেমিট্যান্সও পাঠান পরিবারের সদস্যদের জন্য। কিছুটা পরিবর্তনও আসে পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার। তবে এসব রেমিট্যান্স যোদ্ধার অনেকেই ফিরে আসছেন শূন্য হাতে, অনেকটা নিঃস্ব হয়ে। তাঁদের কেউ কেউ মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে দেশে ফিরছেন। তবে দেশের অর্থনীতির চাকা সচলে ভূমিকা রাখা এসব অসহায় রেমিট্যান্স যোদ্ধার খোঁজ কেউ নেয় না। তাঁদের কল্যাণের বিষয়টি কেবল কাগজে কলমেই থেকে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি বছরও প্রায় ৮০ হাজার প্রবাসী দেশে ফিরেছেন অনেকটা শূন্যহাতে। বিমানবন্দরে প্রবাসী ডেস্ক খোলা হলেও সেখানে কর্তব্যরতরা অনেক কিছুই এড়িয়ে যান। অসহায় ব্যক্তিদের অনেককেই বিমানবন্দরে কর্মরত বেসরকারি সংস্থার কর্মীরা রিসিভ করে তাঁদের পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজটি করে যাচ্ছে।


আবুল কাশেম (৮০)। প্রায় ৩০ বছর ধরে তিনি সৌদি আরব প্রবাসী ছিলেন। গত বছরের ১৮ জানুয়ারি মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় দেশে ফেরেন। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামার পর তাঁকে নিতে কেউ এগিয়ে আসছিলেন না। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা এদিকসেদিক ঘোরাঘুরি করছিলেন এই বৃদ্ধ। অবশেষে তার ঠাঁই হয় ব্র্যাক মাইগ্রেশন সেন্টারে। প্রায় এক সপ্তাহ পর তাঁর ঠিকানা বের করে চট্টগ্রাম হালিশহরের ২৫ নম্বর ওয়ার্ডে বসবাসরত তাঁর পরিবারের সদস্যদের কাছে তুলে দেয় ব্র্যাক মাইগ্রেশন কর্তৃপক্ষ। তবে গত দুই মাস ১০ দিন আগে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান এই অসহায় রেমিট্যান্স যোদ্ধা।


গতকাল কথা হয় প্রয়াত আবুল কাশেমের ছেলে নূর হোসেনের সঙ্গে। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলছিলেন, আমরা প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেছি। বারবার ফোন করেছি। তবে কেউ আমাদের সহায়তা করেনি। অবশেষে আমার বাবা পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন।


সিলেটে ফেঞ্চুগঞ্জের ২৪ বছর বয়সি লায়েক মিয়া। গত পাঁচ বছর আগে হোটেল কর্মী হিসেবে উন্নত জীবনের আশায় তিনি ওমানে গিয়েছিলেন। ২৬ অক্টোবর মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে দেশে ফেরেন। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামার পর থেকে তিনি কাউকে চিনতে পারছিলেন না। তবে ব্র্যাক মাইগ্রেশন সেন্টারের ম্যানেজার আল আমিন নয়নের নেতৃত্বাধীন একটি টিম তাঁর পরিবারের সদস্যদের খুঁজে বের করে তাদের হাতে তুলে দেয় লায়েক মিয়াকে।


লায়েকের ছোট ভাই সিদ্দিক আহমেদ বলেন, আমরা জানি না এ অবস্থায় তিনি কীভাবে বাঁচবেন। কারণ আমাদের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ।


জানা গেছে, বিদেশফেরত বেশির ভাগ মহিলা প্রায়ই খারাপ অবস্থার মুখোমুখি হন। শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের কারণে অনেকে গুরুতর আঘাত সহ্য করেছেন। সামাজিকভাবে হেয় হতে পারেন এমনটা ভেবে তাঁরা অনেক তথ্যই তাঁদের কাছে রেখে দেন। এ ধরনের এক মহিলার এক আত্মীয় বলেছেন যে, তাঁর বোন প্রজনন সংক্রান্ত জটিলতাসহ একাধিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে ফিরে এসেছিলেন। ‘তিনি নিরলস নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছিলেন এবং এখন মানসিকভাবে অস্থির। সে খুব কমই কাজ করতে পারে।


সাত বছর প্রবাসে কাটিয়ে, সারা জীবনের কষ্টার্জিত অর্থ পরিবারে পাঠানোর পরও দেশে ফিরে নিজের জন্য জায়গা হয়নি। এমনই করুণ পরিণতি হয়েছে ফেনীর পরশুরাম উপজেলার পশ্চিম সাহেবনগর গ্রামের ৪২ বছরের রেমিট্যান্স যোদ্ধা আবদুল হকের। গত সোমবার সন্ধ্যায় ফ্লাই দুবাইয়ের একটি ফ্লাইটে সৌদি আরব থেকে দেশে ফেরেন আবদুল হক। দীর্ঘদিন অসুস্থতায় জর্জরিত এই প্রবাসী বিমানবন্দরে স্ত্রী-সন্তানের অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু তাঁদের দেখা না পেয়ে হতাশ হয়ে এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) কাছে সাহায্য চান। বর্তমানে তার ঠাঁই হয়েছে ব্র্যাক মাইগ্রেশন সেন্টারে।


জানা গেছে, ২০১৭ সালে সৌদি আরবে হাউস ড্রাইভারের কাজ নিয়ে পাড়ি জমান আবদুল হক। তাঁর জীবনের সব উপার্জন তিনি স্ত্রী-সন্তানের কাছে পাঠিয়েছেন। কিন্তু সৌদি আরবে শেষ এক বছরে অসুস্থতার কারণে কাজ করতে পারেননি, ফলে উপার্জনও বন্ধ হয়ে যায়। আর এখান থেকেই শুরু হয় সম্পর্কের অবনতি।


মানিকগঞ্জের ৪৯ বছর বয়সি মোহাম্মদ ইমান মোল্লা ছয় মাস আগে উন্নত জীবনের স্বপ্ন নিয়ে মালয়েশিয়া পাড়ি দিয়েছিলেন। তবে সবকিছু হারিয়ে তার স্বপ্ন ভেঙে যায়। অতিরিক্ত কাজের কারণে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন ইমাম। এর বাইরেও প্রতিশ্রুত বেতন না পাওয়ায় তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। সবশেষ গত ২৫ অক্টোবর রাতে তিনি অসহায় হয়ে দেশে ফিরে আসেন।


জানা গেছে, ইমান প্রথমে ১৫ বছর আগে উন্নত ভাগ্যের সন্ধানে মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলেন। তবে এক বছর আগে শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে ফিরে আসতে হয়েছিল তাঁকে। সঞ্চিত অর্থ দিয়ে তাঁর পরিবার তাঁকে চিকিৎসা করায়। তবে দেশে কিছু করতে না পেরে ফের মালয়েশিয়া যান তিনি।


প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) সোয়েব আহমদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আসলে নিয়মের বাইরে তো আমরা কিছু করতে পারি না। বিদেশ থেকে অসহায় কিংবা চাকরিহীন অবস্থায় ফিরে এলে আমরা দেড় লাখ টাকা সহায়তা দিয়ে থাকি। ফিরে আসার ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে আমাদের কাছে আবেদন করতে হবে।


এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কেউ অসুস্থ হয়ে ফিরে এলে বিমানবন্দরে অ্যাম্বুলেন্স সেবাও দেওয়া হয়। এ জন্য প্রবাসী ডেস্ক করছে। এর ব্যত্যয় হলে তা খতিয়ে দেখা হবে। তবে বৈধভাবে প্রবাসে গিয়ে কাজ না পেয়ে ছয় মাসের মধ্যে ফিরে এলে তাদের ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়।


জানা গেছে, গত পাঁচ বছরে ব্র্যাক কমপক্ষে ১০৯ জন ফিরে আসা বাংলাদেশি শ্রমিককে সহায়তা করেছে। এদের বেশির ভাগই মহিলা, কেউ অবৈধ পথে ইউরোপগামী ছিল, কেউ মালয়েশিয়া এবং তুরস্ক থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে ফিরে এসেছিল। তাদের অনেকেই শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের শিকার ছিলেন। কেউ যৌন নিপীড়নের শিকার আবার কেউ অতিরিক্ত কাজের বিপরীতে কম বেতন পাচ্ছিলেন। ফিরে আসা ব্যক্তিদের মধ্যে ৮৭ জন মহিলা এবং ২০ জন পুরুষ। এর মধ্যে সৌদি আরব থেকে সর্বাধিক ৭৯ জন, ওমান থেকে ১২ জন, কাতার থেকে পাঁচজন এবং জর্ডান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়া থেকে দুজন করে এবং লিবিয়া, কুয়েত ও তুরস্ক থেকে একজন করে ফিরে এসেছেন।


ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ফিরে আসা অসহায় রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের পুনর্বাসনের জন্য সরকারের খুব একটা উদ্যোগ নেই। বিমানবন্দরে যারা কাজ করছেন তাদের অনেকেই জানে না তাদের কাজটা কী। আসলে একটা ‘এসওপি’ থাকা দরকার। বিমানবন্দরে কাজ করতে আমাদের কর্মীদের ও অনেক বেগ পেতে হয়। কারণ ফিরে আসা অসহায় ব্যক্তিদের অনেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় থাকেন।


এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ফিরে আসা প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রকৃত সংখ্যা চার থেকে ৫ গুণ বেশি হতে পারে। তবে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৮০ হাজার লোক ফিরে এসেছে। এদের অর্ধেকই এসেছে সৌদি আরব থেকে। কেবল মৃত ব্যক্তিদের জন্য ৩ লাখ টাকা দেওয়া হয়। এটাও তো তাদের দেওয়া টাকায়। এটা বেদনাদায়ক যে আমরা এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ প্রত্যাবর্তনকারীদের পর্যাপ্ত সহায়তা দিতে পারি না।


শরিফুল বলেন, বিমানবন্দরে ফিরে আসা ব্যক্তিদের জন্য কাঠামোগত সহায়তার অভাব রয়েছে এবং সরকারি অফিসগুলোর ভূমিকা নির্ধারণের জন্য স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি)-এর আহ্বান জানানো হয়েছে।


বেসরকারি সংস্থা রামরুর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকী বলেছেন, অভিবাসী শ্রমিকদের পর্যবেক্ষণ এবং পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আগে তাদের সহায়তা করার জন্য বিদেশে স্থানীয় বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের সঙ্গে সহযোগিতা করতে দূতাবাসগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তার জন্য আয়োজক দেশগুলোতে আরও আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপনের, যারা পরিবারে ফিরে আসতে অক্ষম তাদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার এবং শ্রমিকদের অধিকার এবং বিদেশে জন্মগ্রহণকারী শিশুদের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বাড়ানোর সুপারিশ করেন তিনি।


একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালে আউট পাস নিয়ে দেশে ফিরে আসেন ৬৪ হাজার ৪৩৮ জন। এরপর ২০২০ সালে করোনা মহামারি শুরুর পর প্রবাসীরা দেশে ফিরতে শুরু করেন। ওই সময় দেশে ফেরা সব প্রবাসীর হিসাব রাখতে শুরু করে প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক। এতে বছরে প্রায় ৪ লাখ প্রবাসী কর্মীর তথ্য পাওয়া যায়। যদিও তাঁদের মধ্যে একটি বড় অংশ ছুটিতে দেশে আসেন, যাঁদের অধিকাংশই আবার ফিরে গেছেন। তবে এখন ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসা প্রবাসীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে।


ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্য বলছে, গত ২০২৩ সালের ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত শূন্য হাতে দেশে ফিরে এসেছেন ৮০ হাজার ৮১১ জন প্রবাসী। এর মধ্যে পুরুষ কর্মী ৭৮ হাজার ৭৯ জন ও নারী কর্মী ২ হাজার ৭৩২ জন। তবে এটি আরও বাড়তে পারে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। চলতি বছরের পরিসংখ্যানটি প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া হয়নি। তবে একটি সূত্র বলছে, অন্য বছরের মতোই চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৮০ হাজার প্রবাসী দেশে ফিরে এসেছেন। তাদের অর্ধেকের বেশি সৌদি আরব থেকে ফিরে আসা।