রাজধানীর কাঁঠালবাগান ফ্রি স্কুল স্ট্রিট এলাকা। ৭ জানুয়ারি রাত দেড়টা। দুই যুবকের মাঝখানে এক যুবতী হাঁটছিলেন। তাদের বয়স ২০ থেকে ২২ বছরের মতো। কেউই ঠিকমতো হাঁটতে পারছিলেন না। বুঁদ হয়েছিলেন নেশায়। কিছুদূর এগিয়ে বসে পড়লেন একটি ভ্যানের ওপর। ৫-৭ মিনিট জিরিয়ে আবার এগোচ্ছিলেন। কয়েকটি সিএনজি অটোরিকশা চালকের সঙ্গে কথা বলছিলেন তারা।


মনে হচ্ছিল, তাদের গন্তব্যের বিষয়টি ঠিকমতো বুঝিয়ে বলতে পারছিলেন না চালককে। একসময় একটি সিএনজি ম্যানেজ করে কোনোমতে উঠে পড়েন যুবতী। অপর দুই যুবক পাশের একটি গলিতে ঢুকে পড়েন। বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান চালাতেই জানা গেল ভয়ংকর সব তথ্য। ওই এলাকারই একটি নির্মাণাধীন ভবনে তৈরি হয়েছে মাদক স্পট। স্থানীয় অনেক প্রভাবশালী এর দেখভাল করছেন।


ওপরের কেস স্টাডির মতো রাজধানীর বিভিন্ন এলাকাতে এমন দৃশ্যের অবতারণা হচ্ছে হরহামেশাই। স্পটের দেখা মিলছে রীতিমতো অলিগলিতে। ‘চাহিবা মাত্র ইহার বাহককে দিতে বাধ্য থাকিবে’ টাকার লেখা স্লোগানটির মতোই অনেকটা হাত বাড়ালেই মিলছে ভয়ংকর সব ড্রাগস। তবে শর্ত একটাই, প্রয়োজন হবে কোনো মাদকসেবীর রেফারেন্স। ইতোমধ্যে বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষ থেকে মাদকের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযানের কথা বলা হলেও বহাল তবিয়তে মাদক কারবারিরা। প্রশ্ন উঠছে অভিযানকারীদের সক্ষমতা নিয়েও।


খবর মিলছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর দুর্বলতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠছে মাদক মাফিয়া এবং গ্রহীতারা। বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে আগে রাজধানীতে সাড়ে ৩০০ মাদক স্পটের কথা উল্লেখ করা হলেও বর্তমানে তা দেড় হাজার ছাড়িয়েছে। বাইরে থেকে টং দোকানের মতো দেখালেও সেখানে বিক্রি হচ্ছে হরেক রকমের মরণনেশা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সুযোগ কাজে লাগিয়েছে মাদক মাফিয়ারা। কেবল ওই সময়েই দেশে যে পরিমাণ মাদক মজুত করা হয়েছে তা দিয়ে আগামী দুই-তিন বছর চলে যাবে মন্তব্য করেছেন তাদের অনেকে।


অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শেখ হাসিনা সরকারের পতনে বিশেষ ভূমিকা পালন করা ছাত্র সমন্বয়ক এমনকি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা মাদকের বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছেন। মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য তারা কোনো উদ্যোগও নিচ্ছেন না।


ভুক্তভোগীদের পারিবারিক সূত্র বলছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সঠিক নজরদারির অভাবে কিশোর-তরুণের পাশাপাশি বখাটে শিক্ষার্থী প্রকাশ্যে রাজধানীর অলিগলিসহ স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদক সেবন করছে। বিভিন্ন ক্যাম্পাসেও মিলছে স্বল্পমূল্যে নানান মাদক। এতে পড়াশোনার সঙ্গে বিচ্ছেদও ঘটছে শিক্ষার্থীদের। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ছাত্রীদের মাঝেও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলেছে মাদকের বিস্তার।


জানা গেছে, রাজধানীর মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পে এখনো সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মাদক বিক্রি হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকার একাধিক ব্যক্তি বলেন, বর্তমানে শীর্ষ মাদক কারবারির ছয়টি গ্রুপ মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের রয়েছে ৩ শতাধিক সদস্য। তবে শীর্ষ মাদক কারবারির বিরুদ্ধে এলাকার লোকজনও কথা বলতে ভয় পায়। শীর্ষ মাদক কারবারি চুয়া সেলিম সম্প্রতি গ্রেপ্তার হলেও তার প্রতিদ্বন্দী ভূঁইয়া সোহেল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। একই সঙ্গে চুয়া সেলিমের সহযোগী উল্টা সালাম, শান্ত, পিচ্চি রাজা, ফাট্টা আবিদ, পিস্তল নাঈম ও শাহজাদা এলাকায় মাদক কারবার অব্যাহত রেখেছে। এ ছাড়া ক্যাম্পে সক্রিয় রয়েছে মুক্তার, রাশেদ, রাজু, আরশাদ, পিচ্চি রাজা, শাহজাদা, বড় রাজা, পেলু আরমান ও মুন্না। একটি গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছে গালকাটা মনু, শাহ আলম, ইমতিয়াজ, আকরাম চোরওয়া জানু, বিল্লু, সাবু, বাসির ও ইরফান। এদের ৫৫ জনের বেশি সদস্য রয়েছে। একটি গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছে বাবু, সাদ্দাম, মনু, মোফিজ, সুমন, রাজু, নাদিম ও জাম্বু। এদের বেশির ভাগ এখনো ধরা পড়েনি বলে পুলিশ জানিয়েছে।


কেন মাদক নির্মূল করা যাচ্ছে না এমন প্রশ্নের জবাবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএমপির এক শীর্ষ কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, ক্যাম্পের অন্তত ৬৫ শতাংশ লোক প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে মাদকের সঙ্গে যুক্ত। পুলিশ অভিযানে গেলে অপরাধীরা স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের আত্মীয় এবং নেতা-কর্মী পরিচয় দিচ্ছে। ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নিলে ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর বলে তকমা দেওয়ার চেষ্টা করছে। উল্টো নালিশ করছে বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছে। এভাবে চললে ভবিষ্যতের পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।


সরেজমিন মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পে গিয়ে দেখা গেছে, ক্যাম্প ঘিরে থাকা গজনবী রোড, বাবর রোড, শাহজাহান রোড, হুমায়ুন রোডে রয়েছে পুলিশের ক্যাম্প, তল্লাশি চৌকি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতি। তবে কিছুরই তোয়াক্কা করছে না ক্যাম্পে বসবাসকারীরা। একই পরিস্থিতি মিরপুর, পল্লবী বিহারি ক্যাম্প, মিরপুর বেড়িবাঁধ এলাকা, গ্রিন রোড, কলাবাগান, হাজারীবাগ, যাত্রাবাড়ী, কমলাপুর, বাসাবো, বনশ্রী এলাকা। এ ছাড়া কারওয়ান বাজার রেলগেট কেন্দ্রিক এখন আরও ওপেন সিক্রেট। এ ছাড়া সবুজবাগ ওহাব কলোনি, কমলাপুর স্টেশনের আশপাশ এলাকাতেও মাদক রমরমা।


ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্) এস এন মো. নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা চেষ্টার কোনো কমতি রাখছি না। প্রতিনিয়ত নানা ধরনের প্রোগ্রাম করে সদস্যদের মনোবল বাড়নোর চেষ্টা করছি। তাদের নির্ভয়ে কাজ করার নির্দেশ দিচ্ছি। মাদকের বিষয়টি আমাদের বিশেষ গুরুত্বের মধ্যে রয়েছে।


মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) মহাপরিচালক (ডিজি) খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ডিএনসির বাইরেও বর্তমানে বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে এখনো নানা উদ্বেগ-ভয় কাজ করছে। আমরা অভিযানে গেলে পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনীর সাহায্য নিয়ে থাকি। এটা নিরাপত্তার জন্যই প্রয়োজন পড়ে। তবে বর্তমানে পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। এর মধ্যেও আমাদের সফলতা আসছে।


তিনি বলেন, মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বিশেষভাবে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি। এজন্য প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাদকের বিরুদ্ধে সচেতনতার জন্য প্রতিষ্ঠানপ্রধানের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের কমিটি কাজ করছে। প্রতিটি অ্যাসেম্বলি এবং শুরুর ক্লাসে মাদক নিয়ে কথা বলা হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিভাগীয়, জেলা এবং উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা বিষয়টির তদারকি করছেন।