মিয়ানমারের বিদ্রোহী গ্রুপ আরাকান আর্মি মংডু টাউনশিপ নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর রাখাইন রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলে সেনাবাহিনীর সঙ্গে চলছে তুমুল যুদ্ধ। এ অঞ্চলটি থেকে সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ হারালে নিরাপত্তাঝুঁকিতে পড়বে ৫ লাখ রোহিঙ্গা। আরাকান আর্মির সঙ্গে বিরোধের কারণে ওখান বসবাস করা রোহিঙ্গাদের ঠেলে দেওয়া হতে পারে বাংলাদেশে। এ ছাড়া মার্চ-এপ্রিলে রাখাইনে দুর্ভিক্ষের শঙ্কাও করছে জাতিসংঘ। এতে করে খাদ্যসংকটে পড়বে আরও ২০ লাখ লোক। এ দুই কারণে আগামী দু-এক মাসের মধ্যেই বাংলাদেশ অভিমুখে ভয়াবহ রোহিঙ্গা ঢলের আশঙ্কা করা হচ্ছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য পরিস্থিতি নজরদারিতে রাখা শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘নতুন করে কোনো রোহিঙ্গাকে শরণার্থী হিসেবে গ্রহণ করা হবে না। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নাফ নদী ও সীমান্তে কঠোর অবস্থানে আছে বাংলাদেশ।’
নিরাপত্তা বিশ্লেষক কমোডর মোহাম্মদ নুরুল আবছার বলেন, ‘মিয়ানমারের মংডু এরই মধ্যে সেনাবাহিনীর হাত ছাড়া হয়ে গেছে। মিয়ানমারের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল রাখাইনের পশ্চিমাঞ্চলের সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির মধ্য তুমুল যুদ্ধ চলছে। এখানে সেনাবাহিনী পরাস্ত হলে ফের বড় ধরনের রোহিঙ্গা ঢল নামতে পারে।’
জানা যায়, চলতি বছরের জুন-জুলাইতে মংডু ও আশাপাশ এলাকায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং আরাকান আর্মির মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হলে আশ্রয়ের আশায় ঘরবাড়ি ছাড়তে শুরু করে রোহিঙ্গারা। আগস্টের মধ্যেই প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে আসে বাংলাদেশে। সর্বশেষ ৮ ডিসেম্বর মংডু শহর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় আরাকান আর্মি। এতে করে বাংলাদেশ-মিয়ানমার ২৭০ কিলোমিটার সীমান্ত আরাকান আর্মির দখলে চলে যায়।
রাখাইনের পশ্চিমাঞ্চলে দুপক্ষে চলমান রয়েছে যুদ্ধ। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকাটি আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে চলে গেলে চরম বিপাকে পড়বে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা। এরই মধ্যে মংডু টাউনের পাশের পাঁচটি গ্রাম সুধাপাড়া, মংনিপাড়া, সিকদারপাড়া, উকিলপাড়া, নুরুল্লাপাড়া দখল করে ৪০ থেকে ৫০ হাজার রোহিঙ্গাকে উচ্ছেদ করেছে বিদ্রোহী আরাকান আর্মি। বর্তমানে কিছু কিছু পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা প্রবেশ করছে কয়েক দিন ধরে। রাখাইন থেকে উচ্ছেদ হওয়া রোহিঙ্গারা উখিয়ার পালংখালীর আনজুমান পাড়া, নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমঘুম, আশারতলী, ফুলতলা, চাকঢালা, তুমব্রু, লেমুছড়ি দিয়ে অনুপ্রবেশ করছে।
এদিকে জাতিসংঘ আশঙ্কা করছে, আগামী বছরের শুরুতে মিয়ানমারের রাখাইনে দেখা দিতে পারে চরম দুর্ভিক্ষ। সম্প্রতি ইউএনডিপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- রাখাইনে বীজ ও সার সংকট দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতি না বদলালে মার্চ-এপ্রিল নাগাদ, চাহিদার তুলনায় উৎপাদন ৮০ শতাংশ কম হতে পারে। এতে ২০ লাখের বেশি মানুষ অনাহারে ভুগতে পারে।
উখিয়ার পাংলাখালী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এম এ গফুর চৌধুরী জানান, সুযোগে পেলেই দালালের মাধ্যমে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-১১-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাহেল আহমেদ নোবেল বলেন, যে কোনো অপরাধ দমনে বিজিবি সব সময় সতর্ক রয়েছে।
বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটে ১৯৭৮ সালে। দ্বিতীয় দফায় অনুপ্রবেশ ঘটে ১৯৯১-৯২ সালে। তৃতীয় দফা প্রবেশ করে ২০১৬ সালে। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটে ২০১৭ সালের আগস্টের ২৫ তারিখ থেকে। ওই সময় দুই মাসে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা প্রবেশ করে দেশে। তখন আগের রোহিঙ্গা এবং নতুন করে আসা রোহিঙ্গা মিলে বাংলাদেশে রোহিঙ্গার সংখ্যা দাঁড়ায় ১১ লক্ষাধিক। বিগত সাত বছরে নতুন করে জন্ম নিয়েছে আরও দেড় থেকে দুই লাখ রোহিঙ্গা শিশু। চলতি আগস্টের আগে-পরে নতুন করে ৫০ হাজার রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে বর্তমানে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা সাড়ে ১৩ লক্ষাধিক।