জাতীয় নির্বাচনের ডেডলাইন কেন জুন পর্যন্ত, তা নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠছে। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চাইছে। আরেক রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আগামী রোজার আগে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলছে। জুলাই অভ্যুত্থান থেকে জন্ম নেওয়া নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পাটিও (এনসিপি) বলছে, তাদের দাবি পূরণ হলে যেকোনো সময় নির্বাচন হতে পারে। বামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোও যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনে প্রস্তুত বলে জানাচ্ছে খোদ নির্বাচন কমিশন।


এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানাচ্ছেন, আগামী নির্বাচনের ভিত্তি হবে জুলাই চার্টার। সেই জুলাই চার্টারেই উল্লেখ থাকবে কতটা সংস্কার হবে। জুলাই চার্টার বলে দেবে, কতটা সংস্কার বর্তমান সরকার করবে, কতটা করবে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার। পাশাপাশি বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের গুম, খুন ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিচারের রায় নিশ্চিত করতে হবে। যৌক্তিক সংস্কার ও বিচার- এই দুটোর সমন্বয় করতেই আগামী জুন পর্যন্ত নির্বাচনের টাইমলাইন দেওয়া হয়েছে।


এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সংস্কারের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য সৃষ্টির পর যে জুলাই চার্টার হবে, সেটাই হবে নির্বাচনের দিকনির্দেশনা। জুলাই চার্টারের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার বুঝতে পারবে, কতটা সংস্কার করতে পারব আর কতটা পারব না। যেটা করতে পারব না, সেটা পরবর্তী সরকার বাস্তবায়ন করবে।’


শফিকুল আলম বলেন, ‘সংস্কার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কাজ করছে। সেখানে যদি সংবিধান পরিবর্তনে ঐক্য হয় তবে সে ক্ষেত্রে গণপরিষদ নির্বাচনের ইস্যুটি আসবে। এ ছাড়া এই যে সংস্কার কমিশনগুলো বিভিন্ন সুপারিশ জমা দিচ্ছে, এসব সংস্কারের বিষয়েও রাজনেতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্য স্থাপন করতে হবে। এই কাজগুলো ঠিকঠাক সম্পন্ন করার জন্যই আগামী জুন পর্যন্ত স্পেস রাখা হয়েছে।’


সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে যেমন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপ রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর, তেমনই চাপ রয়েছে দৃশ্যমান ও মৌলিক সংস্কারের ওপর। এ ছাড়া জাতীয় নির্বাচনের আগে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ, গুম-খুনের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের রায় নিশ্চিত করার ওপরও চাপ রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর। অভ্যুত্থান ধারণ করে এমন রাজনৈতিক দল ছাড়াও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহত পরিবারগুলোর পক্ষ থেকে রয়েছে ফ্যাসিবাদে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের দাবি। এ ছাড়া এনসিপির পক্ষ থেকে সংবিধান পরিবর্তন এবং এ লক্ষ্যে গণপরিষদ নির্বাচনেরও স্পষ্ট দাবি রয়েছে। এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব জয়নাল আবেদীন শিশির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ও গণহত্যার বিচার এবং সংবিধান সংস্কারের নিশ্চয়তামূলক গণপরিষদ নির্বাচনের বিষয়টি নিশ্চিত হলে এনসিপি যেকোনো সময় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত।’


আবার নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে যেন অহেতুক বিলম্ব না করা হয়, সে বিষয়েও চাপ রয়েছে সরকারের ওপর। অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, উন্নয়ন সহযোগীরাও সরকারপ্রধান ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন করছেন। কখন নির্বাচন হবে, তারা সেই সময়সীমাও জানতে চাইছেন।


বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স জানান, সরকার কেন নির্বাচন অনুষ্ঠানের ডেডলাইন বিলম্বিত করে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত নিচ্ছে, তা আমাদের বোধগম্য নয়। আমরা মনে করি, বর্তমান সরকারের পূর্ণ সংস্কারের ম্যান্ডেট নাই। শুধু নির্বাচনকেন্দ্রিক সংস্কারগুলো সম্পন্ন করে একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকারের হাতে দায়িত্ব তুলে দেওয়াই এই সরকারের কাজ, যাতে করে নির্বাচিত সরকার জাতির প্রত্যাশা অনুযায়ী সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।


জাতীয় নির্বাচনের দিকনির্দেশনা দিতে যে জুলাই সনদ হবে, সেটি নিয়ে কাজ করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি ও সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ঐকমত্য কমিশনের কাজ ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখে শুরু হয়েছে, যা ১৫ জুলাই শেষ হবে। আমরা স্বল্পতম সময়ের মধ্যে একটি জাতীয় সনদ (জুলাই চার্টার) তৈরি করতে চাই। এরই মধ্যে আমরা অনেকগুলো কাজ করেছি। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সুপারিশমালা পাঠিয়েছি। এসব সুপারিশ নিয়ে আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলো দারুণ সমর্থন দিচ্ছে। ফলে এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দীর্ঘসূত্রতার কোনো লক্ষণ আমাদের পক্ষ থেকে নেই।’