নতুন তালিকা ধরে শুরু হবে মাদকের বিশেষ অভিযান। তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী ছাড়াও অভিযান চলবে ঢাকার ১৫০টি বৈধ মদের বারে। টার্গেটে রাখা হয়েছে রাজধানীর মাদকের ৩২৭ স্পট। এরই মধ্যে মাদকের উপ-পরিচালক এবং সহকারী পরিচালকের নেতৃত্বে তৈরি হয়েছে বিশেষ টিম।


সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বড়দিন, বিজয় দিবস, থার্টিফাস্ট নাইটকে ঘিরেই অভিযানের এমন পরিকল্পনা নিয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)।


ডিএনসি সূত্র বলছে, ঢাকা মেট্রো উত্তর এবং দক্ষিণ, বিভাগীয় গোয়েন্দা কার্যালয় ও ঢাকা জেলার সমন্বয়ে বিশেষ সাতটি টিম গঠন করা হয়েছে। আগামী ২৪ ডিসেম্বর ও ৩০ ডিসেম্বর বেলা ৩টায় প্রতিটি টিমকে অতিরিক্ত পরিচালক গোয়েন্দা এবং অতিরিক্ত পরিচালক মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে বিশেষ নির্দেশনা দেবেন। পরবর্তীতে প্রতিটি টিম ডিএনসির প্রধান কার্যালয়ের অপারেশন্স শাখায় স্থাপিত কন্ট্রোল রুমে নিয়মিত অভিযানের আপডেট দেবেন। অতিরিক্ত পরিচালক এ কে এম শওকত ইসলাম স্বাক্ষরিত এ-সংক্রান্তে একটি নির্দেশনা এ প্রতিবেদকের হাতে রয়েছে। ডিএনসির পরিচালক (গোয়েন্দা এবং অপারেশন্স) তানভীর মমতাজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি মাদক নিয়ন্ত্রণে। শুরু হতে যাওয়া স্পেশাল ড্রাইভেও নতুন কৌশল রাখা হয়েছে।


অনুসন্ধান এবং একাধিক সূত্র বলছে, সরকার পরিবর্তনের পর মাদকের কারবার অতীতের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বর্তমানে চলমান সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত। এর মধ্যে মাদক কারবারিরা সুযোগ মতো মাদক ছড়িয়ে দিচ্ছে সারা দেশে। খোদ রাজধানীতেই ৩২৭টি স্পটে খুচরা মাদক বিক্রির তথ্য পাওয়া গেছে। সম্প্রতি মোহাম্মদপুর ও পল্লবী বিহারি ক্যাম্প, হাতিরঝিল রামপুরা ব্রিজ সংলগ্ন এলাকা, সবুজবাগ ওহাব কলোনি, কারওয়ান বাজার, মগবাজার ও তেজগাঁও রেলস্টেশন সংলগ্ন এলাকা, ঢাকা মেডিকেল কলেজের আশপাশ, কমলাপুর রেলস্টেশন-সংলগ্ন এলাকাসহ আরও কয়েকটি স্পটে সন্ধ্যার পর অনেকটা প্রকাশ্যে মাদক বিক্রির চিত্র দেখা গেছে। এ-সংক্রান্তে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের বক্তব্য অনেকটাই একই রকম। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলছেন, প্রতিটি এলাকায়ই একাধিক স্পট রয়েছে। সরকার পরিবর্তনের পরপরই পুলিশি কর্মকাণ্ড কিছুটা কম থাকায় মাদক কারবার বাড়তে শুরু করে। তবে এখন তারা অভিযান বাড়িয়েছেন। টহল জোরদার করা হয়েছে সন্দেহভাজন স্পটগুলোতে। নিয়মিত নজরদারি চলছে এসব স্পটে। বর্তমানে ঢাকায় ভাসমান মাদক বিক্রি বেড়েছে জানিয়ে একটি সংস্থার একজন কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, ঢাকার ৩ শতাধিক স্পটের পাশাপাশি সারা দেশই জেলা-উপজেলা সদরের বিভিন্ন গলিতে ও বাসাবাড়িতেও মাদক বিক্রি হচ্ছে। গ্রামের বাজার, রেলস্টেশনের আশপাশ এলাকাতেও দিন-রাত মাদক বিক্রি হয়। শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ মাদক কিনছে তাদের কাছ থেকে। তবে মাদক কেনাবেচা বন্ধ করতে আলাদা আলাদা টিম করে সারা দেশে অভিযান চলছে।


জানা গেছে, ডিএনসি ঢাকা মেট্রো উত্তর এবং দক্ষিণে ১৫০টি বৈধ মদের বার রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণে ৯টি প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে রয়েছে ১৯টি মদের বার। গুলশানে ৯৭টি প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে লাইসেন্স রয়েছে ১৩১টি। তবে মাদক স্পটে না গিয়ে বর্তমানে অনলাইনেই চলছে বড় একটি অংশের মাদক ব্যবসা। অনেকেই নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য ফোনে অর্ডার করে মাদক সংগ্রহ করছেন। আবার অনেকে তাদের বিশ্বস্ত অনলাইন থেকে সংগ্রহ করছেন। অতি সম্প্রতি তিন নারীসহ মাদকের হোম ডেলিভারি চক্রের মোট সাতজনকে গ্রেপ্তার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। এই অভিযানে ১ হাজার ৬৭০ পিস ইয়াবা, ৭ গ্রাম আইস ও ১৯০ পিস টাপেন্টাডল নামীয় মাদক উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তাররা হলো- আঁখি আক্তার, রিপন আলী, রিফাত রহমান রোদেলা, মোহাম্মদ আলী মুকুল, আফিফ আফতাফ, আনোয়ারা আলেয়া বেগম ও নেয়ামত হোসেন। গ্রেপ্তারদের দেওয়া প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের তথ্যের বরাত দিয়ে এক ডিএনসি কর্মকর্তা বলেন, রাজধানী ঢাকাজুড়ে একটি সক্রিয় মাদকচক্রের সন্ধান পাওয়া যায়। চক্রটির অধিকাংশ সদস্য নারী এবং এরা বিভিন্ন কৌশলে ইয়াবা ও আইস মাদকসেবীদের বাসায় পৌঁছে দেওয়ার কাজ করে। পেট চুক্তিতে ইয়াবা পাচারকারীরা ঢাকার সন্নিকটে বিভিন্ন এলাকায় টেকনাফ থেকে ইয়াবা পৌঁছে দেয়। এসব এলাকা থেকে একটি চক্র মূল মাদকের চালান ভেঙে ভেঙে এসব ডেলিভারি ম্যানদের নিকট পাঠায়। পরে এরা চুক্তি অনুযায়ী ক্রেতাদের নিকট পৌঁছে দিত। গ্রেপ্তারদের মধ্যে রিফাত রহমান রোদেলা মূলত অভিজাত এলাকায় আইস সরবরাহ সিন্ডিকেটের অন্যতম মূল হোতা। ইতোপূর্বে সে আইসসহ গ্রেপ্তার হয়েছিল। ডিএনসি (ঢাকা মেট্রো-দক্ষিণ) মানজুরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মাদক নিয়ন্ত্রণের সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। শুরু হতে যাওয়া অভিযানে পরিদর্শক লেভেলের কর্মকর্তাদের অন্য এলাকায় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বৈধ মদের বারেও আমরা অভিযান চালাব। গত চার মাসে বিপুল মাদকদ্রব্য উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে কয়েক শ মাদক কারবারিকে।


২০১৮ সালের ৪ মে দেশব্যাপী মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান শুরু হয়। তখন থেকেই র‌্যাবের বাইরে পৃথকভাবে মাদক নিয়ন্ত্রণে অভিযান অব্যাহত রেখেছে পুলিশ, বিজিবি ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। বিভন্ন সময়ে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনায় অনেক মাদক কারবারি নিহত হয়েছে। এর পরও মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণে আসেনি। এ ছাড়া মাদক নিয়ন্ত্রণে ঢাকা ও টেকনাফের জন্য গঠন করা হয় বিশেষ টাস্কফোর্স। এর আওতায় সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর ও সীমান্ত এলাকায় নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। বর্তমানে দেশে মাদকাসক্ত মানুষের সংখ্যা ৮০ লাখের বেশি জানিয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এর মধ্যে ৮০ শতাংশই যুবক। মোট মাদকাসক্তের মধ্যে ৪৮ শতাংশ শিক্ষিত। মাদকাসক্তদের মধ্যে ৫৭ শতাংশ আবার যৌন অপরাধী। জেলখানায় যত মানুষ আছে এর বেশির ভাগই মাদক পাচারকারী কিংবা কারবারি। এদের মধ্যে আবার ১৬ শতাংশই নারী। ডিএনসির পরিসংখ্যান বলছে, দেশে বর্তমানে প্রায় ৩০ ধরনের মাদকের মধ্যে ইয়াবা বেশি সেবন করা হয়। দেশে প্রতিদিন প্রায় ৭০ লাখ ইয়াবা বিক্রি করা হয়। এর মধ্যে রাজধানীতে বিক্রি হয় অন্তত ১৫ লাখ। প্রতিটি ইয়াবার দাম ৩০০ টাকা হলে ৭০ লাখ ইয়াবার দাম দাঁড়ায় ২১০ কোটি টাকা। এ ছাড়া সম্প্রতি হেরোইন বিক্রি বেড়েছে।