পারফরম্যান্স বা মাঠের সাফল্য ও ব্যর্থতা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়- এটাই ছিল ক্রীড়াঙ্গনের রেওয়াজ। ২০২৪ সালে সবকিছু ছাপিয়ে আলোচনায় ছিল দুই সভাপতির বিদায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন দাপুটে সংগঠকের কখনো দেখা মেলেনি। দুজনায় ছিলেন পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন। একজন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী সংসদ সদস্য ও শেষের দিকে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে ফুল মিনিস্টার হয়েছিলেন। হ্যাঁ, নাজমুল হাসান পাপনের কথা বলছি। তিনি শুধু বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে দীর্ঘ সময় ধরে সভাপতিই ছিলেন না। পুরো ক্রীড়াঙ্গনই নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন। এক সাবেক প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কাউকে তিনি তোয়াক্কা করতেন না।


এক সময়ের তারকা ফুটবলার কাজী সালাউদ্দিন টানা ১৬ বছর বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন। তিনি কখনো রাজনৈতিক দলে জড়িত না থাকলে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার খুবই কাছের মানুষ ছিলেন। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ ছেলে শেখ কামালের সঙ্গে ছোটবেলা থেকে বন্ধুত্ব ছিল। তার পর আবাহনীতে দীর্ঘ সময় ধরে খেলার কারণে মুজিব পরিবারের ঘনিষ্ঠজন হয়ে ওঠেন। অবশ্য নির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে বাফুফেতে সালাউদ্দিনের আগমন ঘটে ২০০২ সালে বিএনপি ও জামায়াত জোট সরকার আমলে। পাপন ও সালাউদ্দিনের ক্রীড়াঙ্গনে একচ্ছত্র দাপট ছিল। তাদের সামনে মুখ তুলে কথা বলবেন এমন কর্মকর্তা ছিলেন না। এমনকি ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীও তাদের ভয়ে কাঁপতেন। ছিলেন ফেডারেশনের সভাপতি অথচ পুরো ক্রীড়া প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করতেন তারা। বিশেষ করে বিসিবির সভাপতি হওয়ার পর ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যান পাপন। ভাবখানা দেখে মনে হতো তিনিই প্রধানমন্ত্রী। সেই পাপনই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই তার খোঁজ মিলছিল না। শেষ পর্যন্ত খোঁজ মেলে যে, তিনি লন্ডনে পালিয়ে গেছেন। সেখান থেকেই পাপন বিসিবির সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেন। নতুন সভাপতি এখন ফারুক আহমেদ। সালাউদ্দিন অবশ্য পালিয়ে যাননি। সভাপতি পদে থেকেই নির্বাচন না করার ঘোষণা দেন। তাকে হটাতে আন্দোলনও হয়েছিল। এতে লাভ হয়নি। সালাউদ্দিন অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়। যা তার সাংগঠনিক বিজয়ও বলা যায়।


সালাউদ্দিন ১৬ ও পাপন টানা ১১ বছর সভাপতি ছিলেন। এটি কোনো বিষয় নয়, যোগ্যতা ও স্বচ্ছতা থাকলে দীর্ঘ সময় দায়িত্বে থাকা যায়। কিন্তু দুজনই তা কাজে লাগাননি। দীর্ঘ সময়ে থাকায় তারা স্বৈরাচার হয়ে ওঠেন। ক্ষমতায় থাকতে এমন কোনো অনিয়ম নেই যে, তা তারা করেননি। অর্থ লোপাট থেকে নির্বাচনে কাউন্সিলর মনোনয়নেও তারা প্রভাব খাটান। লেনদেনের মাধ্যমেই তা করেন। যাতে নির্বাচনে প্রতিপক্ষ সুবিধা করতে না পারে। বাফুফেতে অর্থ কেলেঙ্কারি এত ভয়াবহ হয়ে উঠেছিল যে, ফিফা বাফুফের সাধারণ সম্পাদককে নিষিদ্ধ করে। সিনিয়র সহসভাপতিকেও জরিমানা করে। এ শুধু বাফুফে নয়, লজ্জাটা দেশেরই। তার পরও সালাউদ্দিনের অপকর্ম থেমে থাকেনি। উন্নয়নের বদলে চেয়ারকে গুরুত্ব দেওয়ায় ফুটবলের মান একেবারে তলানিতে ঠেকেছে। সালাউদ্দিনের প্রভাব দেখে মনে হচ্ছিল মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সভাপতি থাকবেন। কিন্তু দায়িত্ব থেকেই সরে গেছেন। এ ছাড়া উপায়ও ছিল না তার। কেননা, আওয়ামী লীগের পতন ও শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর তিনি নির্বাচন করতে পারতেন না। করলেও ভরাডুবি ঘটত। সালাউদ্দিন সরে যাওয়ায় তাবিথ আউয়াল এখন নির্বাচিত সভাপতি। নয়ছয় করলেও বাফুফে তো অডিট রিপোর্ট পেশ করত। বিসিবি এটাকে গুরুত্বই দেয়নি। শুধু শোনা যেত, বিসিবির যে ফান্ড তাতে অনায়াসে সব ফেডারেশন চালাতে পারে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আয়-ব্যয়ের হিসাব কখনো সেভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। এখন তো অর্থ লোপাটের কথা শোনা যাচ্ছে। দুর্নীতি দমন কমিশন এতে কি নীরব থাকবে? ঠিকই সালাউদ্দিন ও পাপনের দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরবে। কোটি কোটি টাকা ঋণ রেখে গেছেন সালাউদ্দিন। অথচ অফিসের পিয়নরা ঠিকমতো বেতন পেতেন না। সত্যি বলতে কি- দুজনার বিদায়ে ক্রীড়াঙ্গন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে।