আরেক দফা ব্যয় বাড়ছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের। আইনি জটিলতা ও অর্থসংকটের কারণে নয় মাসেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ থাকার পর সীমিত পরিসরে নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। ফুলফেজে শুরু হতে আরও কিছুটা সময় চেয়েছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। তবে সময় বৃদ্ধির কারণে নির্মাণব্যয় আবার বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।


এদিকে গত আগস্টে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের কারণে জটিলতা আরও বেড়েছিল। যার কারণে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে প্রকল্পটি নিয়ে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে প্রকল্পে অনেক জায়গা থেকে নিরাপত্তাকর্মীদেরও সরিয়ে নেওয়া হয়। যেসব এলাকা টিন দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছিল সেসব জাগয়ার টিনও কে বা কারা খুলে নিয়ে যায়। এখন আবার সবকিছু নতুন করে শুরু করতে হচ্ছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে। যা এ প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধিতে এক ধরনের নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে।


এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের পরিচালক এ এইচ এম সাখাওয়াত আখতার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা খুব তাড়াতাড়ি আবার কাজ শুরু করছি। আমাদের সে প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। এবার শুরু হলে দ্রুত সম্পন্ন হবে এ প্রকল্পের কাজ। প্রকল্পসংশ্লিষ্ট আরেক পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, যেহেতু মাঝখানে অনেকটা সময় আমরা লস করেছি, তাতে ব্যয় কিছুটা বাড়তে পারে। তবে কি পরিমাণ ব্যয় বাড়বে সেটা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাবে না। আমরা চেষ্টা করছি আগের চুক্তি অনুযায়ীই কাজটা কীভাবে শেষ করা যায়। কিন্তু যেহেতু ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্মাতা কোম্পানি ইতাল থাইকে বাদ দেওয়া হয়েছে এখন নতুন কোনো কোম্পানিকে যুক্ত করা হতে পারে। এতে করে ব্যয় কিছু বাড়তে পারে বলে ধারণা করছে কর্তৃপক্ষ। তথ্যমতে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণকাজের ৫১ শতাংশ শেয়ারের অধিকারী ছিল ইতালিয়ান থাই (ইতালথাই) ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি। আইনি জটিলতার কারণে সেটাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। শেয়ার নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে ব্যাংক ঋণ ছাড় না হওয়ায় অর্থসংকটে এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ এ বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে ধাপে ধাপে বন্ধ হয়ে যায়। প্রকল্প সূত্র জানায়, শেয়ার হস্তান্তরের বিরুদ্ধে গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে ও অক্টোবরে সিঙ্গাপুরে আইনি লড়াইয়ে ইতালথাই হেরে যাওয়ায় তাদের শেয়ার নিয়ে নিচ্ছে অপর অংশীদার চীনের শেনডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন গ্রুপ। ফলে শেনডংয়ের শেয়ার ৩৪ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৮৫ শতাংশে। শেনডংয়ের সঙ্গে ২৫ বছরের চুক্তি রয়েছে। প্রকল্পটি শেষ করে টোল তুলে তারা সেখান থেকে নির্মাণ ব্যয় তুলে দেবে। এজন্য যত তাড়াতাড়ি প্রকল্পের কাজ শেষ হবে তত তাড়াতাড়ি শেনডং তাদের রিটার্ন নেওয়া শুরু করতে পারবে বলে জানিয়েছে প্রকল্প পরিচালক।


জানা গেছে, শেয়ার নিয়ে দ্বন্দ্ব ও ব্যাংকঋণ সম্পর্কে ওই প্রকল্পের জন্য এফডিইইর চুক্তি হয়েছিল চীনের দুটি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান চায়না এক্সিম ব্যাংক ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়নার (আইসিবিসি) সঙ্গে। তবে সময়মতো সুদ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয় ইতালথাই। ঋণের শর্ত অনুসারে, সুদ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হওয়া প্রতিষ্ঠান তার শেয়ারের অংশ অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করতে পারবে। সুদ পরিশোধ করতে না পারায় চীনা দুটি প্রতিষ্ঠান শেয়ার নিতে চাপ দিলেও ইতালথাই রাজি হয়নি। এ অবস্থায় গত ১৭ জানুয়ারি ব্যাংক দুটি ঋণের অর্থ ছাড় বন্ধ করে দেয়। সেই ঘটনার রেশ চলে টানা নয় মাসের বেশি। অবশেষে সম্প্রতি তা নিম্পত্তি হওয়ায় সীমিত পরিসরে কাজ শুরু হয়েছে। জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ১ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ শেয়ার হস্তান্তরের ওপর স্থগিতাদেশ খারিজ করে দেন। এর পর সিঙ্গাপুর ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন সেন্টারে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে ইতালথাই ও দ্বিতীয় সপ্তাহে শেনডংয়ের আবেদনের ওপর শুনানি হয়। ২০ অক্টোবর সিঙ্গাপুরও ইতালথাইয়ের বিরুদ্ধে রায় দিলে শেয়ার হস্তান্তরে সম্মত হয় প্রতিষ্ঠানটি। ২০০৯ সালে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প নেওয়া হয়। ২০১১ সালে প্রথমে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইতালথাইয়ের সঙ্গে সরকারের ৮ হাজার ৭০৩ কোটি টাকার চুক্তি হয়। সাড়ে ৩ বছরের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ করে দ্রুতগতির উড়ালসড়কটি চালু করার কথা ছিল। তবে অর্থায়ন নিয়ে সমস্যা দেখা দেওয়ায় প্রকল্পটি ঝুলে যায়। এর পর নানা জটিলতার কারণে এবং সবশেষ আইনি জটিলতায় পড়ে আবার কাজ আটকে যায় নয় মাস। এতে করে যে সময়টা লস হয়েছে তাতে অন্তত ২ শতাংশ হারে নির্মাণ খরচ বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।  বিমানবন্দরের কাওলা থেকে শুরু হয়ে কুড়িল, বনানী, মহাখালী, তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী এলাকায় গিয়ে শেষ হবে এ প্রকল্প। ইতোমধ্যে এর প্রথম অংশ বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে।