ইসলাম জ্ঞানার্জনের প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। ‌‌কোরআনের প্রথম নাজিল হওয়া বাক্যে পড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বর্ণিত হয়েছে, ‘পড়ো তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা : আলাক, আয়াত : ১)


এই পড়া শুধু বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং জ্ঞানার্জনের তাগিদে দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করাও ইসলামে গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষঙ্গ।


যুগে যুগে মুসলিম মনীষীরা জ্ঞান অণ্বেষণের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। কখনো মাইলের পর মাইল মরুভূমি পেরিয়েছেন। আবার কখনো সমুদ্রযাত্রা করে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছেন। তাদের শিক্ষা সফর আর আজকের শিক্ষা সফরের মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান লক্ষণীয়।


এসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য জানা সবার জন্য জরুরি।

কোরআনে শিক্ষা সফর


শিক্ষা সফরকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক. স্থায়ী সফর অর্থাৎ ঘর থেকে বের হয়ে এমন কোনো ব্যক্তির কাছে বা এমন কোনো প্রতিষ্ঠানে চলে যাওয়া, যেখানে ইলমের চর্চা হয়ে থাকে। আরেকটি হলো শিক্ষার জন্য অস্থায়ীভাবে দূর-বহুদূর সফর করা।


সাধারণত ভ্রমণের মাধ্যমে শিক্ষা অর্জনের প্রথা পৃথিবীর ঊষালগ্ন থেকে আরম্ভ হয়েছে। নবী-রাসুলরা দাওয়াতের কার্যক্রম এগিয়ে নিতে বিভিন্ন শহর ও লোকালয় ভ্রমণ করেছেন। ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে মানুষ কাফেলা বেঁধে দূর বহুদূর সফর করতেন। সফর দ্বারা নানা জাতিগোষ্ঠী ও সমাজ-সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়া যায়। আল্লাহ তাআলা সৃষ্টির নৈপুণ্যে দেখে ঈমান বৃদ্ধি পায়।


কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ করো এবং দেখো কিভাবে তিনি সৃষ্টিকর্ম শুরু করেছেন। অতঃপর আল্লাহ পুনর্বার সৃষ্টি করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব কিছু করতে সক্ষম।’ (সুরা : আনকাবুত, আয়াত : ২০)


অপরাধ-অপকর্মের কারণে অতীতে অনেক জাতি ধ্বংস হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এখনো তাদের ধ্বংসস্তূপ পাওয়া যায়। ওগুলোর মধ্যেও শিক্ষা গ্রহণের যথেষ্ট উপকরণ বিদ্যমান। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করে না এবং তাদের পূর্ববর্তীদের কী পরিণাম হয়েছিল তা কি দেখে না? যারা মুত্তাকি, তাদের জন্য পরলোকই শ্রেয়—তোমরা কি বোঝো না?’


(সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ১০৯)


মৌলিক শিক্ষা সফর


ইসলামের মৌলিক বা গভীর জ্ঞান অর্জন করার জন্য সফর করা একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এটা এক শ্রেণির মানুষের জন্য ফরজে কেফায়া। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘সব মুমিনের পক্ষে একত্রে বের হওয়া উচিত নয়। তাদের প্রত্যেক দলের একটি অংশ বের হওয়া উচিত, যাতে তারা দ্বিনের গভীর জ্ঞান অর্জন করতে পারে এবং তাদের জাতিকে সতর্ক করতে পারে, যখন তারা তাদের নিকট প্রত্যাবর্তন করে, যাতে তারা সতর্ক হয়।’


(সুরা : তাওবা, আয়াত : ১২২)


জ্ঞান সাধনার জন্য সফর করা ও গভীর অভিনিবেশের সঙ্গে চিন্তাভাবনায় লিপ্ত থাকা অত্যন্ত ফজিলতের কাজ। এ মেহনতের বদৌলতে জান্নাত লাভের পথ সহজ ও সুগম হয়ে যায়। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জ্ঞান অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে কোনো পথ ধরে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন।’ (মুসলিম, হাদিস : ৬৬০৮)


সফরে কষ্ট সহ্য করা


ইলমে দ্বিনচর্চার ইতিহাসে সাহাবায়ে কিরাম ও তাবেঈন থেকে শুরু করে পরবর্তী শত শত বছর ওলামায়ে কিরাম তাফসির, হাদিস, ফিকহ প্রভৃতি শাস্ত্র সংগ্রহের লক্ষ্যে বহু রোমাঞ্চকর পরিভ্রমণ করেছেন। সফরে তাঁরা সহ্য করেছেন অবর্ণনীয় কষ্ট-ক্লেশ। জনৈক ব্যক্তি একটি হাদিসের জন্য প্রায় এক হাজার ২৬৭ মাইল পথ অতিক্রম করেছিলেন। কাসির ইবনে কায়স (রহ.) বলেন, আমি দামেস্কের মসজিদে আবু দারদা (রা.)-এর কাছে বসা ছিলাম। তখন জনৈক ব্যক্তি তাঁর কাছে এসে বলল, হে আবু দারদা! আমি মদিনাতুর রাসুল (সা.) থেকে আপনার কাছে একটি হাদিস শোনার জন্য এসেছি। আমি জানতে পেরেছি যে আপনি রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে তা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, তুমি তো কোনো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে আসনি? সে বলল, না। তিনি বলেন, সম্ভবত অন্য কোনো উদ্দেশ্য হেতু আগমন করেছ? সে বলল, না। তিনি বলেন, অবশ্যই আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি ইলম হাসিলের জন্য সফর করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের রাস্তা সুগম করে দেন। আর নিশ্চয়ই ফেরেশতারা ইলম অন্বেষণকারীর সন্তুষ্টির জন্য তাঁদের পাখাসমূহ বিছিয়ে দেন। আর ইলম অন্বেষণকারীর জন্য আসমান ও জমিনবাসী আল্লাহর কাছে মাগফিরাত কামনা করে, এমনকি পানির মাছও। নিশ্চয়ই আলিমের ফজিলত আবিদের ওপর যেমন, চাঁদের ফজিলত তেমন সব তারকারাজির ওপর। নিশ্চয়ই আলিমরা নবীগণের উত্তরাধিকারী। আর নবীরা দিনার ও দিরহাম উত্তরাধিকার হিসাবে রেখে যান নাই, বরং তাঁরা মিরাস হিসেবে রেখে যান ইলমে দ্বিন। যে ব্যক্তি তা গ্রহণ করল, সে যেন এক বিরাট হিস্যা লাভ করল।


(ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২২৩)


সমাজের চরম বাস্তবতা


আজকাল সমাজের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিবছর শিক্ষা সফরের আয়োজন করা হয়। স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে কিছু কিছু মাদরাসায়ও এখন চালু হয়েছে। বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকেও সফর বা পিকনিকে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। বেশির ভাগ আয়োজনে দ্বিনি শিক্ষা ও চরিত্র গঠনের চেয়ে বিনোদন, অবাধ মেলামেশা ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডই বেশি লক্ষ্য করা যায়। পার্ক, রিসোর্ট বা সমুদ্রসৈকতে উদ্ভট পোশাক, গান-বাজনা ও সেলফি সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে তা আয়োজিত হয়। এর ফলে শিক্ষার্থীদের চরিত্রে নৈতিক অবক্ষয় নেমে আসছে। এগুলো ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। তাই অভিভাবক, শিক্ষক ও আয়োজকদের কর্তব্য—শিক্ষা সফরের নামে সব রকম বেহায়াপনার প্রধান ফটক বন্ধ করে দেওয়া। ইসলামের নীতিমালা অনুযায়ী শিক্ষা সফরের আয়োজন করা। সংক্ষেপে সফরের তিনটি রীতি এমন—


১. সফরের পরিবেশে ইসলামী শালীনতা বজায় রাখতে গানবাদ্য পরিহার করা। ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) শরাব পান করতে, জুয়া খেলতে, ঢোল বা তবলা বাজাতে এবং ঘরের তৈরি শরাব পান করতে নিষেধ করেছেন। আর বলেছেন, প্রত্যেক নেশা সৃষ্টিকারী বস্তুই হারাম। (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৬৪৪)


২. নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া। নারীদের জন্য আলাদা পরিবহনের ব্যবস্থা করা অথবা নারীর সঙ্গে মাহরাম পুরুষ রাখা। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, কোনো পুরুষ যেন অপর কোনো মহিলার সঙ্গে নির্জনে অবস্থান না করে, কোনো স্ত্রীলোক যেন কোনো মাহরাম সঙ্গী ব্যতীত সফর না করে। এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসুল! অমুক অমুক যুদ্ধের জন্য আমার নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু আমার স্ত্রী হজে যাবে। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তবে যাও, নিজ স্ত্রীর সঙ্গে হজ করো।


(বুখারি, হাদিস : ২৭৯৮)