দেশের বেশির ভাগ নাগরিকসেবা এখনো অ্যানালগ। কিছু সেবা অর্ধেক ডিজিটাল, অর্ধেক অ্যানালগ। এখনো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো সনদ পেতে লাইনে দাঁড়িয়ে দিস্তা দিস্তা কাগজপত্র জমা দিতে হচ্ছে। ঘুষের টাকা গুঁজে দিতে হচ্ছে কর্মীর হাতে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির টাকা জমা দিতে ব্যাংকের সামনে তৈরি হচ্ছে তিন হাজার শিক্ষার্থীর লম্বা লাইন। পাসপোর্টের আবেদন অনলাইনে করা গেলেও সেটা আবার প্রিন্ট করে জমা দিতে হচ্ছে। ফলে তথাকথিত ডিজিটালাইজেশনের পেছনে লাখ লাখ কোটি টাকা ব্যয় হলেও কমেনি নাগরিক ভোগান্তি, বন্ধ হয়নি দুর্নীতি।


শিক্ষা খাত, স্বাস্থ্য খাত, বিভিন্ন সেবা খাত, স্থানীয় সরকার বিভাগ, পাসপোর্ট, জন্ম-মৃত্যুনিবন্ধন- সবই চলছে অ্যানালগ পদ্ধতিতে। টেন্ডার প্রক্রিয়াও এখনো শতভাগ ই-টেন্ডারিং পদ্ধতিতে আসেনি। পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের জন্য অনলাইনে আবেদন করা গেলেও সব ডকুমেন্ট প্রিন্ট করে ঠিকই সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করতে হচ্ছে। পকেটে গুঁজে দিতে হচ্ছে ‘চা-পানির খরচ’। না হলে মিলছে না ক্লিয়ারেন্স।


এ ব্যাপারে গত বৃহস্পতিবার বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, অনেক ডিজিটালের কথা শুনে দায়িত্বে এসেছিলাম। কিন্তু সেই সুফল পাইনি। সচিবালয় অগ্নিকান্ডের পর দেখলাম সবই অ্যানালগ। অনেক নথি পুড়ে গেছে, যার ডিজিটাল ডেটাবেস নেই। এগুলো রিকভার করা যাবে কি না, সন্দেহ আছে।


ভুক্তভোগীরা বলছেন, সবকিছু ডিজিটাল হলে দুর্ভোগ কমত। দুর্নীতি কমত। কেউ কোনো সেবা পেতে অনলাইনে আবেদন করলে তার একটা সিরিয়াল নম্বর পড়ত। ধারাবাহিকতা রেখে সেবা না দিলে সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহি আনার সুযোগ তৈরি হতো। ভূমিব্যবস্থাপনা : সার্ভার জটিলতার কারণে মানুষ খাজনা দিতে পারছে না। হচ্ছে না নামজারি। থমকে গেছে জমি রেজিস্ট্রেশন। ভুক্তভোগীরা বলছেন, ভূমিসেবা ডিজিটাল পদ্ধতিতে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। খাজনা দিতে গেলে বলছে সার্ভারে ত্রুটি।


পাসপোর্ট : ফরম পূরণ অনলাইনে করলেও সেটা প্রিন্ট দিয়ে হার্ড কপি জমা দিতে হচ্ছে পাসপোর্ট অফিসে। এরপর ছবি তুলতে ও ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে যেতে হয়। সিরিয়াল পেতে দালাল ধরতে হচ্ছে।


জন্মনিবন্ধন : নতুন জন্মনিবন্ধনের আবেদন বা সংশোধনের আবেদন অনলাইনে করা গেলেও সেটা প্রিন্ট করে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনে গিয়ে জমা দিতে হচ্ছে। মিলছে না ডিজিটালাইজেশনের সুবিধা। ঘুষ না দিলে ঘুরতে হচ্ছে দিনের পর দিন।


জাতীয় পরিচয়পত্র : নতুন ভোটার হতে অনলাইনে ফরম ফিলাপের পর আবার হার্ডকপি জমা দিতে হয় ইসির সংশ্লিষ্ট অফিসে। পাসপোর্ট বা জন্মনিবন্ধনে ব্যক্তির তথ্য থাকলেও এনআইডির জন্য জমা দিতে হয় পাঁচটি ডকুমেন্টের হার্ডকপি।


হাসপাতালে চিকিৎসা : হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে ১০ টাকার টিকিট কাটার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়াতে হয়। এক্স-রে ও বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য টাকা জমা দিতে প্রতিবার লাইনে দাঁড়াতে হয়। অথচ ডিজিটাল পদ্ধতিতে বিল পরিশোধ করা গেলে ভোগান্তি কমত।


অ্যানালগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : শুধু স্কুল-কলেজই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও চলছে অ্যানালগ পদ্ধতিতে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী জানান, কেউ আমেরিকায় থাকলেও সার্টিফিকেট তুলতে হলে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে তিনজনের স্বাক্ষরসহ আবেদন করতে হয়। ৮-১০ দিন পর কিউআর কোড ছাড়া সনদ দেয়, যা আন্তর্জাতিকভাবে যাচাইয়ের সুযোগ নেই। এ জন্য আবার পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বরাবর আবেদন করতে হয়। একই চিত্র সব বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তির সময় শিক্ষার্থীদের লাইন ছাড়িয়ে যায় রেজিস্ট্রার বিল্ডিং থেকে ভিসি চত্বর পর্যন্ত। শিক্ষার্থীরা জানান, সার্টিফিকেট তুলতে কাগজপত্র নিয়ে এক দপ্তর থেকে অন্য দপ্তরে দৌড়াতে হয় দিনের পর দিন। বিভিন্ন ফি দিতে ব্যাংকে গিয়ে লাইন ধরতে হচ্ছে। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের অনলাইন ডেটাবেস না থাকায় জাল সার্টিফিকেট দিয়ে অহরহ চাকরির ঘটনাও ঘটছে।


বিভিন্ন নাগরিক সনদ : ওয়ারিশান সার্টিফিকেট, চারিত্রিক সনদ, অবিবাহিত সনদসহ স্থানীয় সরকার বিভাগের বিভিন্ন সনদ ম্যানুয়ালিই নিতে হচ্ছে। সার্ভারে সংরক্ষণ না করায় এগুলোর সঠিকতা যাচাইয়েরও সুযোগ নেই। আবার একটি ওয়ারিশান সার্টিফিকেট প্রদানের আগে সংশ্লিষ্ট অফিসের তিনজন ব্যক্তিকে শনাক্ত করতে হয়। অথচ এনআইডি, পাসপোর্ট বা জন্মনিবন্ধন সার্ভার থেকেই ব্যক্তিকে শনাক্ত করা সম্ভব।


কাবিননামা : পরিবার নিয়ে প্রবাসীদের বিদেশে স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে যাওয়ার ক্ষেত্রে এক বিড়ম্বনার নাম কাবিন-নিকাহনামা। বিবাহের কাবিননামা ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রদান ও সংরক্ষণ না করায় জটিলতা তৈরি হচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন হোটেলে ভুয়া কাবিননামা দেখিয়ে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে উঠে অবস্থান ও খুনের ঘটনাও সামনে আসছে।