সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে থ্রি হুইলার, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, নসিমন, করিমন চলাচল বন্ধ ঘোষণার পরও দেশের ২২ মহাসড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এসব অবৈধ যান। সরকারি সিদ্ধান্তের নয় বছর পেরিয়ে গেলেও মহাসড়কগুলোয় এসব বিপজ্জনক যানবাহন নির্বিঘ্নে চলছে। ফলে সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা ও মৃত্যু উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। সড়ক নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলেছেন, স্থানীয় প্রশাসন ও হাইওয়ে পুলিশের নির্লিপ্ততা এবং কার্যকর তদারকির অভাবে মহাসড়কে থ্রি হুইলার বন্ধের সিদ্ধান্ত কার্যকর করা যাচ্ছে না। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে স্থানীয় রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা। নিয়মিত চাঁদা দিয়েই সড়কে চলছে এসব ঝুঁকিপূর্ণ যান। ফলে বিভিন্ন উদ্যোগের পরও সড়ক দুর্ঘটনা কমানো যাচ্ছে না। এ বাস্তবতা সামনে রেখেই আজ দেশে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস পালিত হচ্ছে। দিবসটি উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। এবারের নিরাপদ সড়ক দিবসের প্রতিপাদ্য ‘ছাত্র-জনতার অঙ্গীকার, নিরাপদ সড়ক হোক সবার’।


গত এক যুগে দেশের সড়ক নেটওয়ার্ক বাড়লেও সড়ক নিরাপত্তায় কাঙ্ক্ষিত কাজ হয়নি। মহাসড়কে মিশ্রগতির যানবাহনের কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে নিয়মিত। ৭০-৮০ কিলোমিটার গতির দূরপাল্লার বাসের পাশেই চলছে ২০-৩০ কিলোমিটার গতির থ্রি হুইলার, সিএনজিসহ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। ফলে অনিবার্য দুর্ঘটনা ঠেকানো যাচ্ছে না। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কসহ অনেক সড়কে উল্টোপথেও চলাচল করে এসব যানবাহন।


মহাসড়কে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে ২০১৫ সালের ১ আগস্ট থেকে দেশের ২২টি মহাসড়কে থ্রি হুইলার, অটোরিকশা, অটোটেম্পো ও অযান্ত্রিক যানবাহনের চলাচল নিষিদ্ধ করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। এর আগে মহাসড়কে অটোরিকশা ও অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ক্রমবর্ধমান সড়ক দুর্ঘটনা রোধে এ সিদ্ধান্ত কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। প্রয়োজনে মহাসড়কে থ্রি হুইলারের জন্য আলাদা লেন চিহ্নিত করে দেওয়া হবে। সরকারি সিদ্ধান্তের প্রথম দিকে পুলিশি তৎপরতায় মহাসড়কে থ্রি হুইলার চলাচল কমে যায়। এ সময় সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যাও প্রত্যাশিতভাবে অনেক হ্রাস পায়। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই মহাসড়কে থ্রি হুইলার চলাচল বাড়তে থাকে। বর্তমানে সারা দেশের সড়ক-মহাসড়কে অবাধে চলছে নিষিদ্ধ ঘোষিত তিন চাকার যানগুলো। মাঝে একাধিবার মহাসড়কে থ্রি হুইলার চলাচল বন্ধের চেষ্টা করলেও সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা যায়নি।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ, ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ড. এস এম সালেহ উদ্দিন বলেন, ‘মহাসড়কে ধীরগতির এসব ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন দুর্ঘটনার বড় কারণ। মহাসড়ক সব সময় অবারিত থাকা উচিত। এসব ছোট গাড়ির জন্য আলাদা লেন করতে পারলে সুফল পাওয়া যাবে।’


প্রতিদিন ১৭ জনের মৃত্যু : এদিকে গত সাড়ে পাঁচ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় দেশে ৩৫ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে। প্রতি মাসে মারা গেছে ৫৩৬ জন। প্রতিদিন সড়কে মারা গেছেন ১৭ জন করে। ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ বছরে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩২ হাজার ৭৩৩টি। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩৫ হাজার ৩৮৪ জন এবং আহত হয়েছেন ৫৩ হাজার ১৯৬ জন। এসব দুর্ঘটনায় প্রায় ৮৮ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে এক প্রতিবেদনে হিসাব দিয়েছে রোড সেইফটি ফাউন্ডেশন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেপরোয়া গতির ড্রাইভিং, বিপজ্জনক ওভারটেকিং ও মহাসড়কে মিশ্রগতির যানবাহনের কারণে মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় শত শত মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। তাঁরা বলেছেন, গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কগুলো চার লেন করে রোড ডিভাইডার দিতে পারলে বড় দুর্ঘটনা, মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়ানো সহজ হবে। তা ছাড়া মহাসড়কের হাটবাজার অপসারণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ নসিমন, করিমন, ভটভটি, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে পাহারা জোরদার, চালকদের প্রশিক্ষণ, হাইওয়ে পুলিশকে সক্রিয় করাসহ সড়ক পরিবেশ উন্নত করতে না পারলে দুর্ঘটনা রোধ করা কঠিন হয়ে পড়বে। এসব পূর্বশর্ত পূরণ না করে মহাসড়কগুলো শুধু চার লেন করা হলে গাড়ির গতি বাড়বে কিন্তু দুর্ঘটনা কমবে না।


কুমিল্লা অংশ বিপজ্জনক : ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা অংশে দুর্ঘটনার অর্ধেকই তিন চাকার ছোট গাড়ির কারণে ঘটে। মহাসড়কটির কুমিল্লা অংশের ১০৫ কিলোমিটার এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি এলাকায়ই চলছে ইঞ্জিনচালিত ভটভটি, সিএনজি ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, রিকশা ও ভ্যান। কুমিল্লার চান্দিনা থেকে লাকসাম, চৌদ্দগ্রাম পর্যন্ত দরজা খোলা মাইক্রোবাস লোকাল যাত্রী পরিবহন করে। এসব গাড়ির কোনো ফিটনেস নেই। পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড, কোটবাড়ী বিশ্বরোড, আলেখারচর বিশ্বরোড, ময়নামতি, নিমসার, চান্দিনা, গৌরিপুর ও দাউদকান্দি এলাকায় বিভিন্ন ক্রসিং দিয়ে প্রতি মুহূর্তেই এপার-ওপার চলাচল করছে নিষিদ্ধ থ্রি হুইলার। কয়েকজন চালক বলেন, মহাসড়ক দিয়ে গেলে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছা যায়। এ ছাড়া এমন কিছু জায়গা আছে যেগুলো মহাসড়ক দিয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। তারা মহাসড়কে তিন চাকার গাড়ির জন্য আলাদা লেন চান। কয়েকজন বাসচালক জানান, অবৈধ এসব থ্রি হুইলারের অনেক চালক জানেনই না কীভাবে মহাসড়কে গাড়ি চালাতে হয়। তারা হুট করে দ্রুতগতির গাড়ির সামনে চলে আসেন। যখন ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার গতিতে একটি বাস চলে তখন এসব নিষিদ্ধ যান হুট করে সামনে চলে এলে আমাদের ব্রেক করে গাড়ি থামাতেও বেকায়দায় পড়তে হয়। এতে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে।


মহাসড়কের কাঁচপুর সেতু থেকে মেঘনা সেতু পর্যন্ত অটোরিকশা ও যান্ত্রিক যানবাহন চালকদের দৌরাত্ম্য অব্যাহত আছে। সোনারগাঁয়ের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে অবাধে যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে অটোরিকশা দিয়ে। মহাসড়কের পাশেই গড়ে উঠেছে অবৈধ স্ট্যান্ড। এসব থ্রি হুইলার মহাসড়কে চলাচল করায় প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা।


সার্ভিস লেনে কমেছে দুর্ঘটনা : ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের দুই পাশে সার্ভিস লেন যুক্ত হয়েছে। গাজীপুরের চন্দ্রা থেকে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা পর্যন্ত মহাসড়কের পাশে সার্ভিস লেন যুক্ত হওয়ায় এ অংশে দুর্ঘটনা কমে এসেছে। এ ছাড়া এলেঙ্গা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত মহাসড়কে সার্ভিস লেন না থাকায় মহাসড়কেই অবৈধ থ্রি হুইলার চলাচল করছে। মহাসড়কের যেসব অংশে সার্ভিস লেন নেই সে অংশের থ্রি হুইলার মহাসড়কে দূরপাল্লার গাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলাচল করছে। এ ছাড়া জেলা শহর থেকে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহসহ আঞ্চলিক সড়কগুলোয়ও থ্রি হুইলার অবাধে চলছে। সার্ভিস লেনের কারণে মহাসড়কে থ্রি হুইলার চলাচল কম করায় দুর্ঘটনা অনেক কমে গেছে বলে মন্তব্য করেছে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের উদ্যোক্তা ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘আমাদের দেশে মানুষের মধ্যে আইন মানার অভ্যাস তৈরি হয়নি। এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদেরও দেখা যায় আইন ভঙ্গ করতে। এজন্যই সড়কে বিশৃঙ্খলা কমছে না। বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা।’ তিনি বলেন, ‘মহাসড়কে মৃত্যুর মিছিল রোধ করতে আমাদের হাইওয়েগুলোতে ছোট গাড়ি চলাচল, মানুষ পারাপার, হাটবাজার পুরোপুরি নিষিদ্ধ করতে হবে। ডিভাইডার দিয়ে মহাসড়কের দুই পাশ বন্ধ করে দিতে হবে। গাড়ি থামার জন্য আলাদা বাস বে তৈরি করতে হবে।’