আওয়ামী লীগ আমলের ধসেপড়া শেয়ারবাজারে কোনোভাবেই আস্থা ফিরছে না। সরকার পরিবর্তনের পর ঘুরে দাঁড়ালেও কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে ফের অস্থিরতার মধ্যে পড়েছে বাজার। পরিস্থিতি এতই জটিল হয়েছে যে চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমেছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সূচক। গত এক মাসের বেশি সময় ধরে টানা দরপতন হয়েছে। গত সপ্তাহের লেনদেনের শুরুতে দুই দিনে ২৫০ পয়েন্টের বেশি পতন ডিএসইতে। এই পতনে আতঙ্কিত সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বিক্ষোভও করেছে। তারা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের পদত্যাগের দাবি জানান। গত সপ্তাহের শুরুতে ভয়াবহ দরপতনের পর অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বৈঠক করেন বিএসইসির কর্মকর্তাদের সঙ্গে। এরপর কিছুটা ঘুরে দাঁড়ায় শেয়ারবাজার। তবে এই ঘুরে দাঁড়ানোকেও সাময়িক বলছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, বাজার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে মিলে শেয়ার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শুধু দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দিয়ে শেয়ারবাজার স্থিতিশীল হবে না।


অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে শেয়ারবাজারের লেনদেন হওয়া ১২ সপ্তাহের মধ্যে মাত্র দুই সপ্তাহ শেয়ারবাজারে মূল্য সূচক বেড়েছে। বাকি ১০ সপ্তাহজুড়ে দরপতন দেখা গেছে। শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর শেয়ারবাজারে বড় উল্লম্ফন হলেও নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম দুই সপ্তাহ শেয়ারবাজারে বড় দরপতন হয়। তবে তৃতীয় সপ্তাহে এসে শেয়ারবাজারে কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী হয়। কিন্তু চতুর্থ সপ্তাহে আবার দরপতন হয়। পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, নবম, দশম ও ১১তম সপ্তাহেও দরপতনের ধারা অব্যাহত থাকে। এ সময় ডিএসইর সূচক ডিএসইএক্স ১০০০ পয়েন্টের বেশি হারিয়েছে। ৬ হাজার ১৫ পয়েন্ট থেকে কমে ৪ হাজার ৯০০ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছিল। ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স গত সপ্তাহে বেড়েছে ৮৪ দশমিক ৮০ পয়েন্ট বা ১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এর আগের সপ্তাহে সূচকটি কমে ১৪৩ দশমিক ৩৮ পয়েন্ট বা ২ দশমিক ৭৩ শতাংশ। তার আগের ১০ সপ্তাহে সূচকটি কমে ৮০৯ পয়েন্ট। ফলে গত সপ্তাহে মূল্য সূচক বাড়লেও অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর শেয়ারবাজারে লেনদেন হওয়া ১২ সপ্তাহে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক সব মিলিয়ে কমেছে ৭২৫ পয়েন্ট। ধারাবাহিক দরপতন থেকে বেরিয়ে গত সপ্তাহে দেশের শেয়ারবাজারে কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী হয়। গত সপ্তাহের শেষ তিন কার্যদিবসে টানা বেড়েছে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম। এতে মূল্য সূচকের বড় উত্থানের পাশাপাশি বেড়েছে বাজার মূলধন। প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বাজার মূলধন প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। প্রধান মূল্য সূচক বেড়েছে প্রায় ১০০ পয়েন্ট। সেই সঙ্গে বেড়েছে লেনদেনের পরিমাণ। গত সপ্তাহজুড়ে ডিএসইতে লেনদেন হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ২৭৯টির স্থান হয়েছে দাম বাড়ার তালিকায়। বিপরীতে দাম কমেছে ১০১টির। আর ১৫টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। ফলে সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসের লেনদেন শেষে ডিএসইর বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৬৫ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা। যা আগের সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে ছিল ৬ লাখ ৫৬ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ সপ্তাহের ব্যবধানে বাজার মূলধন বেড়েছে ৮ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা বা ১ দশমিক ২৯ শতাংশ।


জানতে চাইলে ডিএসইর সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নান বলেছেন, রাষ্ট্র কাঠামোতে একটি বড় পরিবর্তনের পর শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক ব্যক্তিদের রদবদল হয়েছে। এই পরিবর্তন ও রদবদলে মানুষের মধ্যে প্রত্যাশা জেগেছিল দীর্ঘদিনের হতাশা থেকে তারা বের হতে পারবে। অনিয়ম, দুর্নীতি, জালিয়াতি বন্ধ হয়ে শক্তিশালী শেয়ারবাজার গড়ে উঠবে। কিন্তু মাত্র কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে মানুষের সেই প্রত্যাশা কর্পূরের মতো উড়ে গেছে। বাজারে এখন চরম অব্যবস্থাপনা, বিশৃঙ্খলা চলছে। শুধু ব্যক্তির রদবদলে বাজারের কোনো উন্নতি হবে না। দীর্ঘদিনের যে অনিয়ম দুর্নীতি তার জন্য শুধু আগের দুই চেয়ারম্যান দায়ী নন। আরও কিছু কারণ রয়েছে এই অনিয়মের পেছনে। নীতি, আইনগত অনেক জটিলতার কারণে মানুষ আস্থা পাচ্ছে না বাজারে বিনিয়োগ করার বা ধরে রাখতে। তিনি বলেন, নতুন কমিশন গঠন হওয়ার পর আমরা বলেছিলাম, অংশীজনের সঙ্গে মতামত নিয়ে শেয়ারবাজার বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য। কিন্তু কমিশন সেটা করেনি। তারা নিজেদের মতো দীর্ঘমেয়াদি কিছু রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে। এগুলো আদৌ বাজারের জন্য কোনো ইতিবাচক কিছু ফলাফল আসবে কি না সেটা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। বাজার যে একেবারে শেষ হয়ে যাচ্ছে তার জন্য দ্রুত সমাধান করতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। এনবিআর ঘোষিত কিছু করারোপ করা হয়েছে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে লভ্যাংশের ওপর। মানুষ কোটি কোটি টাকা লোকসান করে বসে আছে। তার ওপর উল্টো কর আরোপ করেছে। এসব করলে আস্থা ফিরবে না। যারা অংশীজন রয়েছে তাদের সঙ্গে নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এভাবে বাজার চলতে পারে না।