গুলশানে শহীদ তাজউদ্দীন স্মৃতি পার্ক ও মাঠ। এর আয়তন ৮ একর। এ মাঠ ও পার্কটি গুলশান ইয়ুথ ক্লাব দখল করে রেখেছে। মাঠ ও পার্কের সব প্রবেশপথে নিজেদের নিরাপত্তা প্রহরী বসিয়ে জনসাধারণের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করছে। বৃষ্টির পানি শোষণের জন্য রাখা উন্মুক্ত স্থানটি তারা ঢালাই দিয়ে বন্ধ করে ফুটবলের মাঠ বানিয়েছে। রূপ পরিবর্তনের মাধ্যমে তারা পার্কটিকে নিজেদের দখলে নিয়েছে।
এর ফলে মাঠে প্রবেশাধিকার নেই শিশুদের। ঘনবসতির শহর ঢাকাতে এমনিতেই খেলার মাঠের সংকট। অধিকাংশ স্কুল-কলেজে নেই সুপরিসর খেলার মাঠ। রাজধানীর পুরনো মাঠগুলোও চলে গেছে বড়দের বিভিন্ন ক্লাবের দখলে। তাই খেলাধুলার উপযুক্ত পরিবেশ ছাড়াই বেড়ে উঠছে শিশুরা।
শহীদ তাজউদ্দীন স্মৃতি পার্ক ও মাঠ নিয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে তিনটি মামলা দায়ের এবং নিষ্পত্তি হয়। এই মামলাগুলোতে আপিল বিভাগ এবং হাই কোর্ট বিভাগ রাজউককে দখল উচ্ছেদে নির্দেশ দিয়েছে। একই সঙ্গে সিটি করপোরেশনকে কোনোভাবে লিজ বা দখল দেওয়া বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছে।
একই অবস্থা ধানমন্ডি মাঠের। এই মাঠটি একসময় উন্মুক্ত ছিল। কিন্তু কিছু দিন পর বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ক্লাব মাঠটি দখল করে নেয়। ধীরে ধীরে পুরো মাঠে ক্লাবটি নানা স্থাপনা তৈরি করে। এখন শুধু ক্লাবের সদস্যদের প্রশিক্ষণের জন্য মাঠটি সংরক্ষিত। আর ক্লাবটি লাখ লাখ টাকায় শেয়ার বিক্রি করে কোটিপতি হয়ে ওঠে। সম্প্রতি গণপূর্ত অধিদপ্তর নিজস্ব সাইনবোর্ড স্থাপন করলেও তা গোপনে সরিয়ে ফেলা হয়।
শুধু এ দুটি মাঠই নয়, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতায় ৫৭টি মাঠ ও পার্ক রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩১টি ও উত্তর সিটি করপোরেশনের ২৬টি। এগুলোর অধিকাংশ সংস্কার করে বিভিন্ন সংগঠনের তত্ত্বাবধানে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে কিছু মাঠ ও পার্ক ইজারা দেওয়া হয়েছে। যার বেশির ভাগই দখলে রয়েছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) ২০১৯ সালের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা শহরে খেলার মাঠ আছে ২৩৫টি, যার মধ্যে ১৪১টি প্রাতিষ্ঠানিক মাঠ। এসব মাঠে শিশু কিংবা সাধারণ নাগরিকদের প্রবেশাধিকার নেই। জানা গেছে, গত ২২ বছরে ১২৬টি খেলার মাঠ হারিয়ে গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শহীদ তাজউদ্দীন মাঠ, শ্যামলী শিশুপার্ক, শ্যামলী পার্ক, নারিন্দা শিশুপার্ক, ইরাকি মাঠ, ঢাকা জেলা পরিষদ শেখ রাসেল শিশুপার্ক, শ্যামলী পার্ক মাঠ, শ্যামলী ঢাকা, শ্যামলী ক্লাব মাঠ, ছাদের হাট খেলার মাঠ ও ঈদগাহ, হুমায়ুন রোড খেলার মাঠ, উদয়াচল পার্ক ও খেলার মাঠ এবং তাজমহল রোড মাঠটি দখলে রয়েছে। এসব মাঠ দখল করে দোকান ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চালাচ্ছে, মেলার জন্য ভাড়া দিচ্ছে, স্থাপনা তৈরি করেছে (যেমন মাঠ বন্ধ করে সুইমিং পুল, জিমনেসিয়াম তৈরি করেছে), পার্ক বা মাঠে সাধারণ মানুষকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। মাঠ রক্ষণাবেক্ষণের নামে বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দিয়ে রাখে ও প্রতি খেলার জন্য টাকা দিয়ে সদস্য হয়ে খেলতে হচ্ছে।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, কমিউনিটি মাঠ শুধু কমিউনিটি-ভিত্তিক খেলাধুলার জন্য। এ মাঠ উন্মুক্ত থাকবে, যাতে শিশু-কিশোর অবাধে এবং মুক্তভাবে খেলতে পারে। কিন্তু কমিউনিটির মাঠগুলো বিভিন্ন ক্লাব বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বানিয়ে দখল করে নিচ্ছে। প্রথমে মাঠের পাশে একটি ক্লাব হাউস তৈরি করছে। পরে ক্লাবের উদ্যোগে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শুরু করে। এরপর ধীরে ধীরে ভবনসহ ব্যাডমিন্টন ও টেনিস কোট, একাধিক ক্রিকেট অনুশীলন স্থান তৈরি করে। এগুলোর মাধ্যমে মাঠ ক্লাবগুলোর দখলে চলে যায়। এতে স্থানীয় কিশোর-তরুণরা মাঠে খেলতে পারে না।
এ বিষয়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সাধারণ সম্পাদক মেসবাহ উদ্দিন আহমদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ঢাকা শহরে এমনি পর্যাপ্ত মাঠ নেই। আর যেগুলো উন্মুক্ত রয়েছে সেগুলো সিটি করপোরেশনের আওতাধীন। কিন্তু সিটি করপোরেশন সংস্কার করার পর অপারেটর ও ক্লাবকে তত্ত্বাবধায়ক দিয়েছে। সেগুলোতে সাধারণ মানুষ খেলতে পারছে না।
তিনি বলেন, মাঠ দখল ও ইজারা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। শিগগিরই সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো দখল উচ্ছেদ করতে হবে। অপারেটর নিয়োগ বন্ধ করে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে। সরকারি খরচে উন্নয়নের পর সাধারণ মানুষ কেন ফি দিয়ে খেলবে।