মানসম্মত শিক্ষা প্রদানে অনেক পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ কম থাকা, রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতি, শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মানে ছাড় দেওয়া, শিক্ষকদের কম বেতন-ভাতা প্রদানসহ নানা কারণে এ খাতে আশানুরূপ অগ্রগতি আসেনি। শিক্ষার জন্য বিভিন্ন দপ্তর, অধিদপ্তর ও কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারার কারণেও পিছিয়ে আছে এ দেশের শিক্ষা। রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা, যথাযথ তদারকি না হওয়া, অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতিও শিক্ষার মান তলানিতে থাকার বড় কারণ। এসব নানা কারণেই আন্তর্জাতিক মান থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশের শিক্ষা।


দেশে বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ৫৫টি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ১১৫টি। দেড় শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও এসব বিশ্ববিদ্যালয় গুণে-মানে অনেক পিছিয়ে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন র‌্যাঙ্কিংয়েও আশানুরূপ কোনো অবস্থান করতে পারেনি উচ্চশিক্ষার এসব বিদ্যাপীঠ। চলতি বছর প্রকাশিত যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান কোয়াককোয়ারেলি সায়মন্ডস (কিউএস) ‘কিউএস ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র?্যাঙ্কিং’ এ দেখা গেছে এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের করুণ অবস্থার চিত্র। এই র‌্যাঙ্কিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল ৫৫৪তম। বুয়েট অবস্থান করছে ৭৬১ থেকে ৭৭০-এর মধ্যে। অথচ সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এই র‌্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষ দশে (অষ্টম) অবস্থান করে নিয়েছে। র‌্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষ পঞ্চাশে ছিল পার্শ¦বর্তী দেশ ভারতের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়। যুক্তরাজ্যভিত্তিক টাইমস হায়ার এডুকেশনের ‘এশিয়ান ইউনিভার্সিটি র‌্যাঙ্কিং’-এও দেখা গেছে হতাশার ছবি। এই র‌্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষ ৩০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় নেই বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেয়েছে ৪০১-৫০০-এর মধ্যে। বুয়েট ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ৩০১ থেকে ৩৫০-এর মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ৩৫১ থেকে ৪০০-এর মধ্যে। গতবারের চেয়ে এবারের র‌্যাঙ্কিংয়ে আরও অনেক পিছিয়ে গেছে এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এ তালিকায় শীর্ষস্থানে রয়েছে চীনের সিনহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে দেশটির পিকিং ইউনিভার্সিটি। তৃতীয় স্থানে রয়েছে সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। শীর্ষ দশে অবস্থান করা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে পাঁচটিই চীনের। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠদান, গবেষণা, নলেজ ট্রান্সফার, বৈশ্বিক ভাবমূর্তি, শিক্ষক প্রতি শিক্ষার্থী অনুপাতসহ বিভিন্ন বিষয় আমলে নিয়ে এই র‌্যাঙ্কিং করা হয়। এসব সূচকে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের তেমন অগ্রগতি না থাকায় পিছিয়ে গেছে র‌্যাঙ্কিংয়েও। দেশের শিক্ষা খাতের বৃহৎ অংশই পরিচালিত হয় বেসরকারি খাতে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৮০ শতাংশের বেশি পরিচালিত হচ্ছে বেসরকারি ধারায়। এ শিক্ষকরা বেতন-ভাতার ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার ভিত রচনা করেন। কিন্তু এসব শিক্ষককে বেতন দেওয়া হচ্ছে ১৩তম গ্রেডে। তাঁরা এখনো বিবেচিত হচ্ছেন কর্মচারী হিসেবে। শিক্ষকদের মর্যাদা ও আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়টি সরকার কখনো আমলে নেয়নি বলে অভিযোগ শিক্ষকদের।


শিক্ষা খাতে যথাযথ বরাদ্দ না থাকার কারণেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শিক্ষার মানে। চলতি অর্থবছরের শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৯৪ হাজার ৭১১ কোটি টাকা। এ বাজেট বরাদ্দ জিডিপির মাত্র ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এ বরাদ্দ বৃদ্ধির জন্য ইউনেস্কোসহ শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানালেও কোনো সরকার এতে গুরুত্ব দেয়নি। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সরকার ও নীতিনির্ধারকরা শিক্ষার মানোন্নয়নে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন চুক্তিতেও স্বাক্ষর করেছেন তারা। কিন্তু মানোন্নয়নের জন্য করা বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি আর চুক্তির প্রতিফলন আমরা দেখিনি। শিক্ষা মৌলিক মানবাধিকার। কিন্তু এই মানবাধিকার নিশ্চিত করতে পারেনি সরকার। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সব স্তরেই শিক্ষার মানে ঘাটতি রয়েছে। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এ দেশে শিক্ষার মানোন্নয়নে কখনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। অথচ দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে শিক্ষার মান বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। তিনি বলেন, শিক্ষার মান বাড়াতে হলে শিক্ষকের মান বাড়াতে হবে, তাদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষকদের যথার্থ সম্মান ও মর্যাদা দিতে হবে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, দেশে কর্মসংস্থান বাড়ছে না। কর্মসংস্থান না থাকলে পড়াশোনা করে হতাশ হয়ে পড়ে তরুণ-তরুণীরা। দেশে বিগত সময়ে যে উন্নয়ন হয়েছে তাতে কর্মসংস্থান বাড়েনি। শিক্ষার মান বাড়াতে এ খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির পাশাপাশি এ বরাদ্দ যথাযথভাবে ব্যয় করার পরামর্শ দেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।